শেখ রোকন, দেশকন্ঠ অনলাইন : দেড় শতাব্দীর বেশি আগে কবি ইশ্বরচন্দ্র গুপ্ত লিখেছিলেন- ‘রেতে মশা দিনে মাছি, এই তাড়ায়ে কলকাতায় আছি’। বৃহৎ বঙ্গের অপর প্রধান শহর বর্তমানে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার ক্ষেত্রে এখনকার কোনো কবি হয়তো লিখতে পারেন- ‘শীতে কাশি বর্ষায় ভাসি, এই নিয়ে ঢাকায় আছি’।
বলা বাহুল্য, বর্ষা ও শরৎ ঋতুর চার মাস বাদ দিলে বছরের বাকি সময় ঢাকাবাসীকে ধুলা ও ধোঁয়ার সঙ্গেই বসবাস করতে হয়। বায়ুদূষণের দিক থেকে প্রায়ই বৈশ্বিকভাবে সর্বোচ্চ স্থান অধিকারের মাধ্যমে আমাদের ‘গৌরব’ বৃদ্ধি করে এই শহর।
বায়ুদূষণ মানে অবধারিতভাবেই নীরব ঘাতকের হাতে প্রাণ সঁপে দেওয়া। মনে আছে, গত বছর আগস্টে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল দূষিত বায়ুতে নিঃশ্বাস নেওয়ার কারণে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু প্রায় ৭ বছর কমছে। তার আগের বছরের ডিসেম্বরে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনেও বলা হয়েছিল, এ দেশে প্রতি বছর ৮০ হাজারের বেশি নাগরিকের অকাল মৃত্যুর কারণ মাত্রাতিরিক্ত বায়ুদূষণ।
বস্তুত বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড অনুযায়ী যেখানে প্রতি ঘনমিটার বায়ুতে সর্বোচ্চ ৫ মিলিগ্রাম দূষণ নাগরিকদের জন্য সহনীয় হওয়ার কথা; সেখানে ঢাকার বাতাসে দূষণকারী গ্যাসীয় কণার উপস্থিতি এর ১৪-১৫ গুণ। চিকিৎসা ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বরাবরই বলে আসছেন যে, বায়ুদূষণের জের ধরে নাগরিকদের ফুসফুস বিশেষভাবে ঝুঁকির মুখে। যে কারণে শীতকালে ঢাকার গলিতে কান পাতলেই কাশির শব্দ শোনা যায়। শীত-বসন্ত গড়িয়ে গ্রীষ্মকালে যখন ঝড়-বৃষ্টির মৌসুমে এগিয়ে আসে, ক্রমেই যেন কাশির দমক কমতে থাকে। বর্ষাকালে স্বাভাবিকভাবেই ঢাকার আকাশ নির্মল হয়ে ওঠে, বুড়িগঙ্গার কালো কুচকুচে প্রবাহ মেটে রং ধারণ করতে থাকে, কংক্রিটের আগ্রাসনে কায়ক্লেশে টিকে থাকা উদ্যানগুলো গাঢ় সবুজ হয়ে উঠতে থাকে।
কিন্তু বর্ষাকালে ঢাকার নতুন বিপদ হিসেবে ক্রমেই বাড়ছে জলাবদ্ধতা। দুই দশক আগেও ভারী বৃষ্টিপাতে নির্দিষ্ট কয়েকটি এলাকায় পানি জমতো। এখন কোন এলাকায় পানি জমে না–সেটিই যেন গবেষণার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রথম দিকে ভারূ বৃষ্টিপাতে পানি জমতো, এখন দেখা যাচ্ছে মাঝারি বৃষ্টিপাতেও রেহাই নেই।
অবশ্য শুক্রবার ছুটির দিন যে বৃষ্টিপাতে ঢাকার অলি-গলি পেরিয়ে রাজপথও ডুবেছিল, সেটি মাঝারি তো নয়ই, ভারী বৃষ্টিপাতের মধ্যেও অতিভারী। সকাল ৬টা থেকে বেলা ১২টা পর্যন্ত ৬ ঘণ্টায় অন্তত ১৩০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছিল।
এটি ঠিক, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঢাকায় অল্প সময়ে অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের হার বেড়েছে। যেমন গত ২৭ মে ২২৪ মিলিমিটার, গত বছরের ২১ সেপ্টেম্বর ১১৩ মিলিমিটার, তার আগের বছর ২৫ অক্টোবর ২২৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছিল (সমকাল, ১৩ জুলাই ২০২৪)। কিন্তু তারিখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে, এগুলো ঘটেছে সামুদ্রিক ঝড়ের মৌসুমে; মূলত ঘূর্ণিঝড় বা নিম্নচাপের প্রভাবে। এগুলোর সঙ্গে শুক্রবারের বৃষ্টিপাতের তুলনা চলে না। বর্ষাকালের মৌসুমি বৃষ্টিপাত এত ভারী হওয়ার কথা শুধু নয়; ২৪ ঘণ্টার বদলে মাত্র ৬ ঘণ্টায় এত বৃষ্টিপাত বিরল। আরও ভেঙে বললে, সিংহভাগ ঘটেছে প্রথম তিন ঘণ্টায়।
এটিও ঠিক, শুক্রবারের বর্ষণ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ‘ক্লাউড বার্স্ট’ বা মেঘ বিস্ফোরণের কথা মনে করিয়ে দেয়। এর ফলে বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে স্বাভাবিক বৃষ্টি ঝরানোর বদলে সীমিত অঞ্চলে স্বল্প সময়ে অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হয়। সাম্প্রতিক দিনগুলোতে বাংলাদেশে এই ধরনের দুর্যোগ ক্রমেই বাড়ছে। যেমন গত বছর আগস্টে চট্টগ্রাম অঞ্চলে এ ধরনের রেকর্ড বর্ষণে বান্দরবানের পার্বত্য অঞ্চলেও বন্যা দেখা দিয়েছিল; চট্টগ্রাম-কক্সবাজার নবনির্মিত রেলপথ ভেসে গিয়েছিল। তার আগের বছর, ২০২২ সালের জুন মাসে, মেঘালয়-সিলেট অঞ্চলে শতবর্ষের রেকর্ড ভেঙেছিল বৃষ্টিপাত। শুক্রবারের বৃষ্টিপাত মেঘ বিস্ফোরণের ঢাকা সংস্করণ কিনা, আবহাওয়াবিদরা ভালো বলতে পারবেন।
আমার কথা হচ্ছে, সাম্প্রতিক দিনগুলোতে যদিও এই ধরনের দুর্যোগ বাড়ছে, ঢাকাই দুর্ভোগের দায় জলবায়ুর কাঁধে তুলে দিয়ে পার পাওয়া যাবে না। মেঘ-বিস্ফোরণ যদি ঘটেও থাকে; ঢাকায় জলাবদ্ধতার কারণ অন্তত ভূগোলে নেই; আছে অব্যবস্থাপনায়। অল্পসময়ে অধিক বৃষ্টিপাতে নগর কিংবা শহরে পানি জমতেই পারে; কিন্তু এর নিষ্কাশনে দীর্ঘসময় লাগার কোনো কারণ নেই। এ বিষয়ে আমার সন্দেহ সামান্য যে, উপযুক্ত পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা থাকলে যত বৃষ্টিপাতই হোক, দুই-এক ঘণ্টার মধ্যে নগরের পানি নেমে যেতে বাধ্য।
পরিকল্পনা, প্রকল্প ও সেগুলোর ‘বাস্তবায়ন’ ঢাকা নগরীতেও কম হয়নি। প্রকাশ্য রাজপথে হাঁটু বা ততোর্ধ্ব পর্যন্ত কাপড় তুলে বা ভিজিয়ে চলাচলকারী নাগরিকদের মনে থাকার কথা, গত সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগে জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের কথা ইশতেহারে বলেছিলেন মেয়রদ্বয়। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র গত বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি পুরান ঢাকার ওয়ারীতে এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, বর্ষায় অতিবৃষ্টি হলেও ১৫ মিনিটের মধ্যে পানি নিষ্কাশিত হবে। শুক্রবার এসে দেখা যাচ্ছে, সেই অতিবৃষ্টির পানি ১২ ঘণ্টাতেও সরছে না। গত ১৯ মে নগর ভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে দক্ষিণের মেয়র যদিও বলেছিলেন, ঢাকার জলাবদ্ধতার সমস্যা ৭০ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশে নেমে এসেছে, শুক্রবারের পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে ১০ শতাংশ থেকে বেড়ে ৭০ শতাংশে ঠেকেছে।
এটি বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার নেই যে, পরিকল্পনা ঠিকঠাক হলে বৃষ্টির পানি দ্রুতই সরে যেত। নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান যথার্থই বলেছেন, নগরকর্তারা ও তাদের পরামর্শদাতারা জানেনই না যে, ঢাকায় কত মিলিমিটার বৃষ্টি হলে কোন অংশে কতটুকু জলাবদ্ধতা হবে (সমকাল, ১৩ জুলাই ২০২৪)। এর ওপর রয়েছে পরিকল্পনার ভিত্তিতে যেসব প্রকল্প হয়, সেগুলোও ঠিকমতো বাস্তবায়ন না হওয়ার প্রশ্ন। ঢাকা ওয়াসা ও সিটি করপোরেশন সূত্র উদ্ধৃত করে সংবাদমাধ্যম বলছে, গত এক যুগে জলাবদ্ধতা নিরসনে কমপক্ষে ৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে (সমকাল, ১৩ জুলাই ২০২৪)। তিন হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে তিন বর্গকিলোমিটার এলাকার জলাবদ্ধতাও কি কমানো গেছে? নাকি আরও বেড়েছে?
আসলে ঢাকায় তো জলাবদ্ধতার ঝুঁকিই ছিল না। ঢাকার চারপাশের বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা কেবল নয়; এর মাঝখান দিয়েও ছিল নড়াই, ধোলাই, পাণ্ডু, সোনাভান নদী। ছিল আরও শতাধিক প্রাকৃতিক খাল। সরকারি সংস্থা মৎস্য অধিদপ্তরের হিসাবেই ১৯৮৫ সালেও ঢাকায় দুই হাজারের মতো পুকুর ছিল। যত বৃষ্টিপাতই হোক, নদী-খালে গড়িয়ে যেতে বা বিল-পুকুরে গিয়ে জমতে সময় লাগার কথা ছিল না।
বেদনা ও বিক্ষোভের বিষয়, ঢাকার ভেতরের চার নদী হারিয়ে গেছে। শতাধিক খালের অর্ধেকের বেশি দখলে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। যেগুলো টিকে আছে, সেগুলোও গভীরতা কমে ধারণক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিংয়ের সমীক্ষা রিপোর্টে দেখা গিয়েছিল, ১৯৮৫ সালের পর থেকে ঢাকার ১০ হাজার হেক্টরের বেশি জলাভূমি, খাল ও নিম্নাঞ্চল হারিয়ে গেছে।
ক্রমেই আবদ্ধ হয়ে ওঠা স্থল ও অন্তরীক্ষের ঢাকায় জল তাহলে যাবে কোথায়? নদী, খাল, বিল, পুকুর যখন দখল ও ভরাটে জেরবার, তখন উন্মুক্ত এলাকা বলতে তো সড়কগুলোই অবশিষ্ট। বৃষ্টির পানি তো কবি বিনয় মজুমদারের মতো, সীমানা মানে না। গলি বা রাজপথ, বসতি বা ব্যবসাকেন্দ্রের ফারাক বোঝে না। যেখানে ফাঁক কিংবা ফাঁকা পাবে, সেখানে গিয়েই জমবে।
শেখ রোকন: লেখক ও নদী-গবেষক
দেশকন্ঠ//