মোয়াজ্জেম হোসেন রাসেল : খেলাধুলার যে কোন আসরে যেমন নতুন খেলোয়াড় তৈরি হয় ঠিক তেমনি পুরনো আর পিছিয়ে পড়াদেরও সুযোগ তৈরি হয়। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল) ক্রিকেটের আসর তেমনি। দীর্ঘদিন পর ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেটের এ আসর দেশি ক্রিকেটারদের নৈপুন্যে ভাস্বর ছিল। মিরপুরের শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে তিন’দিন আগে প্রথমবারের মতো ফাইনালে ওঠা সিলেট স্ট্রাইকার্সকে হারিয়ে বিপিএলেল শিরোপা জিতে নিয়েছে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স। তবে বিপিএল শুরুর আগে বেশ আক্ষেপ নিয়ে সাকিব আল হাসান বলেছিলেন, ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্টটির এত আসর থেকে নাকি মাত্র দু’জন তরুণ ক্রিকেটার বের হয়েছেন! সে তুলনায় সদ্য শেষ হওয়া নবম আসরে বেশ ক’জন তরুণ ক্রিকেটার নজর কেড়েছেন। যার মধ্যে সবার আগের নামটি তৌহিদ হৃদয়, যিনি এই বিপিএলের পারফরম্যান্স দিয়ে জাতীয় দলে ডাক পেয়েছেন। নানা সমালোচনার তীরে বিদ্ধ হওয়া নাজমুল হোসেন শান্ত দারুণ ধারাবাহিকতায় নিজেকে নতুন করে চেনালেন। বাহাতি তানভীর ইসলাম বিপিএল দিয়ে জাতীয় দলের স্পিন বিভাগে যুক্ত হওয়ার দাবি জানিয়ে রাখলেন। তরুণ পেস বোলার হাসান মাহমুদও উইকেট শিকারে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। ব্যাটিংয়ে সিলেটের জাকির হাসান সামর্থ্য দেখিয়েছেন।
এছাড়া তরুণ পেসার তানজিম হোসেন সাকিব সম্ভাবনার ইঙ্গিত রেখেছেন। তারুণ্যের টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টে তরুণরা পারফর্ম করেছেন। আবার এই তরুণদের দাপটের মাঝে দু’জন প্রায় হারিয়ে যাওয়া ক্রিকেটার নিজেকে ফিরে পেয়েছেন। এর বাইরে দু’জনের মধ্যে নানা বিতর্কে জর্জরিত নাসির হোসেনের যেন পুনর্জন্মই হয়েছে এবার। ব্যাটে-বলে দুরন্ত পারফর্ম করে তিনি সবাইকে চমকে দিয়ে জাতীয় দলে ফেরার দাবী জানিয়ে রেখেছেন। ব্যাট হাতে ১২ ম্যাচে ৩৬৬ করে রান সংগ্রাহকদের তালিকায় ষষ্ঠ হয়ে আলো ছড়িয়েছেন। আর অফস্পিনে ১৬ শিকার নিয়ে উইকেট সংগ্রাহকের তালিকায় দ্বিতীয় হয়েছেন। স্পিন অলরাউন্ডার হিসেবে জাতীয় দলের মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত ও শেখ মেহেদি হাসানরা যখন ধারাবাহিকতা দেখাতে পারছেন না, সেখানে বিপিএলে দুর্দান্ত পারফর্ম করে নাসির যেন দাবি জানিয়ে রাখলেন। বিপিএলে নিজেকে ফিরে পেয়েছেন ঘরোয়া ক্রিকেটে পরীক্ষিত পারফরমার রনি তালুকদারও।
শিরোপা জিততে না পারলে রংপুর রাইডার্সের সাফল্যের অন্যতম কারিগর জাতীয় দলের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এ ওপেনার। ১৩ ম্যাচে ৪২৫ করে রান সংগ্রহে দ্বিতীয় স্থানে ছিলেন তিনি। জাতীয় দলের ওপেনার নাজমুল হোসেন শান্তকে কেন এত সুযোগ দেয়া হয়, সমালোচকদের এটি ছিল একটি কমন প্রশ্ন। শান্ত দারুণ ধারাবাহিকতায় প্রশ্নের জবাব তো দিয়েছেন, পাশাপাশি বিপিএলের রেকর্ড বইয়েও নাম লিখিয়েছেন। ৯টি বিপিএলে শান্ত হলেন একমাত্র বাংলাদেশি যে কিনা ৫০০ রানের মাইলফলক স্পর্শ করেছেন। একমাত্র দক্ষিণ আফ্রিকার রাইলি রুশো রংপুর রাইডার্সের হয়ে ২০১৯ সালে ৫০০ রান করে সবার ওপরে ছিলেন। এ কীর্তি তৌহিদ হৃদয়ও করতে পারতেন যদিনা ইনজুরিতে না পড়তেন। এমনকি শান্তকে ছাড়িয়ে রান সংগ্রহে সেরাও হতে পারতেন। কিন্তু তাঁর দুর্ভাগ্য, দুর্দান্ত ব্যাটিংয়ে টানা তিন খেলায় ম্যাচসেরা হওয়ার পর ফিল্ডিং করতে গিয়ে আঙুল ফেটে যায় তাঁর। এ জন্য প্রায় দুই সপ্তাহ মাঠের বাইরে ছিলেন। এর পরও ১২ ইনিংসে ৪০৩ করে রান সংগ্রাহকদের তালিকায় তৃতীয় অবস্থানে ছিলেন। যার পুরস্কার হিসেবে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম দুই ওয়ানডের দলে ডাক পেয়েছেন তিনি। বিপিএলে জাতীয় দলের অনেক তারকা ছিলেন ভীষণ নিষ্প্রভ।
তবে দীর্ঘদিন জাতীয় দলের সাথে থাকা ইয়াসির আলী চৌধুরী রাব্বিকে ব্যাট হাতে খুঁজে পাওয়া যায়নি। জাতীয় দলের মিডলঅর্ডারের আরেক তারকা আফিফ হোসেন দুটি হাফ সেঞ্চুরিতে ৩৪৪ রান করেছেন, কিন্তু তাঁর ব্যাটিং দলের তেমন একটা উপকারে আসেনি। এ ছাড়া নাঈম শেখ, সৌম্য সরকার, এনামুল হক বিজয়, মাহমুদুল হাসান জয়, নুরুল হাসান সোহান, শামীম হোসেন পাটোয়ারীর মতো মুখগুলো তেমন ভালো করতে পারেননি। স্পিনারদের মধ্যে নাসুম আহমেদ, নাজমুল ইসলাম অপু, মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত, শেখ মেহেদি হাসান, মেহেদী হাসান মিরাজও সাফল্যের দেখা পাননি। বরং তানভীর, নাসির, নিহাদুজ্জামানরা বাজিমাত করেছেন। বিপিএলে সব সময় অভিজ্ঞরা ভালো করলেও এবার এর ব্যতিক্রম দেখা গেছে। সাকিব ও লিটন ছাড়া তামিম, মুশফিকুর রহিম, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদদের মতো অভিজ্ঞরা এবার প্রত্যাশা মেটাতে পারেননি। আর এটাই হয়তো পালাবদলের সূচনা! যা থেকে শেখার আছে অনেককিছু।
এদিকে বিপিএলের জৌলস ফেরানোর তাগিদ দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ স্পোর্টস ল’ অ্যান্ড ল’ইয়ার্স ফাউন্ডেশনে আয়োজনে জাতীয় প্রেস ক্লাবে ‘কেমন হলো বিপিএল-২০২৩’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা রকিবুল হাসান, সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ স্পোর্টস ল’ অ্যান্ড ল’ইয়ার্স ফাউন্ডেশনের (বিএসএলএলএফ) উপদেষ্টা পর্ষদ চেয়ারম্যান, জাতীয় ক্রীড়া ভাষ্যকার আলফাজউদ্দিন আহমেদ। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিএসএলএলএফ উপদেষ্টা পর্ষদ কো-চেয়ারম্যান, জাতীয় ক্রীড়া ভাষ্যকার সামসুল ইসলাম। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আন্তর্জাতিক ক্রীড়া পরামর্শক ডা. অনুপম হোসেন, খোদা বকস্ মৃধা ফাউন্ডেশনের সহসভাপতি পলাশ খান, জাতীয় ক্রীড়া ভাষ্যকার মোহাম্মদ কামরুজ্জামান ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের কল্যাণ সম্পাদক জুবায়ের রহমান চৌধুরী। ১৪টি দেশে এবারের বিপিএল সরাসরি সম্প্রচার হয়েছে, কিছুকিছু গণমাধ্যম ঢালাওভাবে কিছু ভুলভাল তথ্য প্রচার হয়েছে, যাহা কাম্য নয়। তাদের মনে হয়েছে ডিআরএস এবং এআরএসের আইন নিয়ে অনেকের মাঝে স্বচ্ছ ধারণা ছিল না। আশা করি ভবিষ্যতে এমন ভুল বোঝাবুঝি আর থাকবে না।
দেশকণ্ঠ/আসো