মৃণাল কুমার বন্দ্য : একটা সময় উপজেলা নির্বাচন মানেই ছিলো গ্রাম-গঞ্জে উৎসবের আমেজ, চায়ের দোকানে ভিড়, আলোচনা, প্রচার প্রচারণা। নির্বাচনের অনেক আগে থেকেই প্রার্থীরা তাদের প্রচারণা শুরু করে দিতেন। বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে দোয়া চাইতেন। গ্রামের বাজারেও চলতো মধ্যরাত অবধি বিভিন্ন আলোচনা, গল্পে মেতে উঠতেন সব বয়সী মানুষেরা। মহিলা ভোটারদের ভোট পেতে চলতো বিভিন্ন বাড়িতে বাড়িতে মহিলাদের দিয়ে প্রচারণা। নির্বাচনী মাঠ, ভোটার অনুকূলে আছে মনে করলেই দাড়াতেন ভোটে (নির্বাচনে)। এই উপজেলা নির্বাচনী ব্যয় মেটাতে গিয়ে জমি কিংবা দোকান বিক্রি করার অনেক নজির আছে।
সময় পাল্টেছে। এখন ক্ষমতাসীন দলের একটা টিকিট পেলেই নির্বাচনে পাস! ক’জন চেয়ারম্যান বা কাউন্সিলর আছেন, যাদের সাথে সাধারণ মানুষের যোগাযোগ আছে? এক কথায়, নেই! স্থানীয় সংসদ সদস্যের অতি কাছের প্রার্থীরাই পান দলীয় টিকেট। এরপর চলে শোডাউন। ব্যস, হয়ে গেলো নির্বাচন। অথচ যে কারণে এই তৃণমূল নির্বাচনের এতো গুরুত্ব ছিলো, আগ্রহ ছিলো সাধারণ মানুষের, সেটি হারিয়ে গেছে।
এখন একজন সংসদ সদস্য প্রকাশ্য জনসমাবেশে হুমকি দিতে পারেন- যারা তার ছেলেকে ভোট দিবেন, তাদের উন্নয়ন করবেন তিনি, বাকিদের করবেন না! এটা নাকি গিভ এ্যন্ড টেক! একবার ভেবে দেখুন, সাধারণ মানুষ কতোটা অসহায় উনাদের কাছে, কতোটা নিরুপায়! যাকে ভোট দিয়ে (!) সংসদ সদস্য বানিয়েছেন, যিনি শপথ নিয়েছেন সেই এলাকার উন্নয়নের, নিরপেক্ষ থাকার, তার হুমকি শুনতে হয়! এখন তার ছেলেকেও ভোট দিতে হবে। এমন উদ্ধত্যপূরণ বক্তব্যের পরও কোন দলীয় কিংবা সরকারের পক্ষ থেকে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। অবশ্য সাধারণ জনগণ এখন সেটা আশাও করেন না।
শুধু সংসদ সদস্য নন, দলীয় তৃণমূল কর্মীরাও শুনতে চান না দলীয় নির্দেশ! দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের সন্তান, নিকটাত্মীয় ও স্বজনেরা ভোটের মাঠে রয়ে গেছেন। সোমবার প্রথম পর্বের ভোটের (৮ মে) মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিনে মাত্র তিনজন মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের স্বজন সরে দাঁড়িয়েছেন। আরও ২০ জনের বেশি স্বজন উপজেলা চেয়ারম্যান পদে ভোটের লড়াইয়ে থেকে গেছেন। এখন পর্যন্ত মন্ত্রী-এমপিদের দুই স্বজনসহ সাতজন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হওয়ার পথে। আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্ত অমান্য করে দ্বিতীয় পর্বে নতুন করে আরও প্রায় ৩৫ জন মন্ত্রী-সংসদ সদস্যের স্বজন চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হয়েছেন। চেয়ারম্যান পদে দলীয় সিদ্ধান্ত না মানায় ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের স্বজনদের বসাতে কোনো চেষ্টাই করেনি আওয়ামী লীগ।
একই অবস্থা বিরোধী প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি তেও। বিএনপি উপজেলা পরিষদের নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিলেও দলটির অন্তত ৩৮ জন সাবেক-বর্তমান নেতা এবং তাঁদের স্বজন চেয়ারম্যান পদে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করছেন। প্রথম দফার নির্বাচনে তাঁরা মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেননি। এই ৩৮ জনের মধ্যে ১৮ জন বিএনপির স্থানীয় পর্যায়ের পদধারী নেতা। বাকি ২০ জনের মধ্যে ১১ জন দল থেকে বিভিন্ন সময়ে বহিষ্কৃত, অব্যাহতিপ্রাপ্ত এবং বিএনপির সাবেক নেতা ও অঙ্গসংগঠনের নেতা রয়েছেন। এ ছাড়া বিএনপির নেতাদের আত্মীয়স্বজন বা এই দলের লোক হিসেবে পরিচিত আরও ৯ জন নির্বাচনে রয়েছেন।
বিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, এই ধাপে দলের সাবেক-বর্তমান মিলে ৪৯ নেতা মনোনয়নপত্র দাখিল করেছিলেন। এর মধ্যে ১১ জন প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেন। অনেকে সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচন না করার ঘোষণা দেন। ১৫ এপ্রিল বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে উপজেলা নির্বাচন না করার সিদ্ধান্তের পর দলটির নেতৃত্বের চেষ্টা ছিল দলীয় প্রার্থীদের নির্বাচন থেকে ফেরানোর। এ লক্ষ্যে দলের কেন্দ্রীয়, বিভাগীয় ও জেলার নেতাদের বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু দলীয় সিদ্ধান্ত এবং নেতাদের সব চেষ্টা-তদবির উপেক্ষা করে ৩৮ জন নির্বাচন করছেন। এর মধ্যে দলের থানা-উপজেলা কমিটির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকসহ ১৮ জন বিভিন্ন পর্যায়ের পদধারী নেতা রয়েছেন। আগামী ২১ মে দ্বিতীয় ধাপে সারা দেশে ১৬০ উপজেলায় নির্বাচন হবে। দ্বিতীয় ধাপেও বিএনপির অন্তত ৩৫ নেতা মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।
আওয়ামী লীগের দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে মাদারীপুর সদরে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী রয়ে গেছেন সংসদ সদস্য শাজাহান খানের ছেলে আসিবুর রহমান খান, নোয়াখালীর সুবর্ণচরে সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরীর ছেলে আতাহার ইশরাক চৌধুরী, বগুড়ার সারিয়াকান্দিতে সংসদ সদস্য সাহাদারা মান্নানের ছেলে মোহাম্মদ সাখাওয়াত হোসেন এবং সোনাতলা উপজেলায় সাহাদারা মান্নানের ছোট ভাই মিনহাদুজ্জামান। অতীতে বহুবার দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে প্রার্থী হওয়া নেতাদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়েছে। এমনকি গাজীপুরের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে দুবার ক্ষমা করার নজির আছে। ফলে কেউ দলের সিদ্ধান্তকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। কারণ, তাঁদের ধারণা ক্ষমা পেয়ে যাবেন নির্বাচনের পরে।
ক্ষমা পান বা না পান, এতে করে যে তৃণমূলের সাথে দলের চেইন অব কমান্ড ভেঙ্গে পড়লো, সেটা জুড়বে কে? এই বিভেদ সৃষ্টি এবং ভারসাম্য হারানোতে মূল ক্ষতির আশঙ্কা যে সাধারণ জনগনেরই।
mrinalbanday@gmail.com
দেশকণ্ঠ//