• শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১  নিউইয়র্ক সময়: ০৫:৩৫    ঢাকা সময়: ১৫:৩৫
সমকালীন প্রসঙ্গ

জাতিগত ঐক্য কি সম্ভব?

  • মতামত       
  • ২৩ নভেম্বর, ২০২৪       
  •       
  • ১২:৫৩:৫৯

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, দেশকন্ঠ অনলাইন : আমরা জাতিগত ঐক্য চাই; কিন্তু কী জন্য? কার প্রয়োজনে? এ একটা জিজ্ঞাসা বটে। আমাদের জিজ্ঞাসা থাকে একটি, এই ঐক্য আদৌ সম্ভব কি? তারপরে আসা যাবে ঐক্যের ভিত্তিটা কী? শুরু করা যাক– ঐক্য সম্ভব কি? যাকে ঐক্য বলি, সে তো আকাঙ্ক্ষা শুধু। অথবা ধারণাই কেবল। কেননা, মানুষে মানুষে মিল কোথায়? পাঁচজন মানুষ মানেই পাঁচটি স্বতন্ত্র প্রাণী। একজন মানুষই বা কি এক থাকে সর্বদা? সে কি বদলায় না, বর্ষে বর্ষে? অনেক সময় ক্ষণে ক্ষণে? হ্যাঁ, এই রকমের পার্থক্য আছে। থাকে। থাকবে। বাগানের সব ফুল এক রকমের নয়। ফুল নয় কেবল, লতাপাতাও আছে। আগাছাও থাকে। তবু সব মিলিয়ে একটা ঐক্য থাকে। সেটা বাগানের ঐক্য। জাতীয় ঐক্যও ওই রকমের। বিভিন্নতা থাকবে; বৈচিত্র্য অবলুপ্ত হবে না; তবু এক জায়গায় এক থাকবে সব মানুষ; এক পরিচয়ে।

আরও ভালো উপমা বোধ করি নদীর স্রোত। ওই স্রোতে বিন্দু বিন্দু পানি আছে, বালুও আছে। বালুর কণাগুলো এক হয় না; পানির কণাগুলো হয়। মিলেমিশে তবেই তারা পরিণত হয় ধারাপ্রবাহে। তখন গৌরব বাড়ে; বৃদ্ধি পায় সৌন্দর্য। শক্তিবান হয়। উর্বর করে ভূমি; ফসল ও ফুলে ভরে দেয় দু’ধার; গড়ে তোলে জনপদ। এই স্রোত থেকে বের হয়ে এলে জলবিন্দুর কী মূল্য? সে বালুর কণাও নয়। বালুর কণা তবু থাকবে টিকে, জলবিন্দু থাকবে না; শুকিয়ে মরবে অচিরে। জাতীয় ঐক্য ওই প্রবহমান স্রোতধারা। বিন্দু বিন্দু পানি যাতে মিলিত হয়ে শক্তি, মর্যাদা ও ফলপ্রসূতা পেয়ে যায়। সে জন্যই জাতীয়তাবাদ মূল্যবান এবং প্রয়োজনীয়। ভেতরে একটা ভয়ও থাকে– একা হলে শুকিয়ে যাবে; যাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে।

কিন্তু জাতীয়তাবাদ এক রকমের নয়। অন্তত দু’রকমের তো বটেই। এখানে এসে নদীর উপমাটি স্তব্ধ হয়ে যায়; ভিন্ন উপমা খুঁজতে হয় এবং খুঁজে পাওয়া কষ্ট হয়। কেননা, জাতীয়তাবাদ কেবল যে ভয় থেকে তৈরি হয়, তা নয়। তার উদ্ভব আগ্রাসনের ইচ্ছা থেকেও ঘটতে পারে। ঘটেছে। সেই জাতীয়তাবাদ আরেক ধরনের। পাড়ার মাস্তানরা পাড়া পাহারা দেয়; ভালো কথা। ঘেউ ঘেউ করে; সেটা ভালো। সতর্ক করে দেয় মহল্লাবাসীকে। কিন্তু যখন তারা ছুটে যায় অন্যকে আক্রমণ করবে বলে, তখন তাদের চেহারা যায় বদলে। তারা হয়ে ওঠে আগ্রাসী, আক্রমণকারী। তাদের আচরণও হয়ে যায় ভিন্ন রকম ভয়ংকর।

বিশ্বনাগরিক হওয়া অন্যায় কিছু নয়, ভালোই বরঞ্চ; প্রশংসনীয়। কিন্তু সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়বার আগে একটি গৃহ চাই; চাই একটি আশ্রয়। আকাশে তাকাবে যে, গ্রহণ করবে আলো, তাপ ও বাতাস। তাকেও দাঁড়াতে হবে মাটিতেই।

প্রাচীনকালে আধুনিক রাষ্ট্র ছিল না। এখনকার অর্থে জাতিও ছিল না, কিন্তু দেশপ্রেম ছিল, যাকে এক ধরনের জাতীয়তাবাদ বলা সম্ভব। মহাকাব্যে বর্ণনা আছে ট্রয়ের যুদ্ধের। সেটা জাতীয়তাবাদী যুদ্ধই। গ্রিকদের এক রানীকে ফুসলিয়ে নিয়ে গেছে ট্রয়ের এক রাজকুমার। শুনে গ্রিসের সব রাজ্যেশ্বর এক হয়ে আক্রমণ করল ট্রয়। যুদ্ধ চলল ১০ বছর। তারপর ট্রয় ধ্বংস করে দেশে ফিরতে আরও ১০ বছর। হোমার বলেছেন সেই কাহিনি। যুদ্ধ এবং গৃহে প্রত্যাবর্তনের। জাতীয়তাবাদী যুদ্ধ শেষ করে ঘরে ফিরছেন অডিসিয়ুস। ফেরার পথে ঝড় উঠেছে। পথ হারিয়েছেন; বন্দি হয়েছেন মানুষখেকোদের হাতে; খপ্পরে পড়েছেন মায়াবিনীর। অন্যত্র আতিথেয়তাও পেয়েছেন মানবীয়; কিন্তু বিচ্যুত হননি মুহূর্তের জন্যও। ১০ বছর পরে সব বিপদ পার হয়ে, বন্ধন ছিন্ন করে অডিসিয়ুস ফিরে এলেন স্বদেশে। দেশপ্রেমিক তিনি; জাতীয়তাবাদী।

জাতীয়তাবাদ তাই অবশ্যই দু’রকমের। একটি আগ্রাসী, আধিপত্যবাদী, দখলকারী। অপরটি প্রতিরোধমূলক, আত্মরক্ষাকারী। একটি সন্ত্রাস সৃষ্টিকারীর, অপরটি সন্ত্রস্তের। জাতীয়তাবাদ কী জন্য প্রয়োজন, কার জন্য প্রয়োজন– এই প্রাথমিক প্রশ্নের জবাব আমরা এখানেই পেয়ে যাব। প্রয়োজন উভয় পক্ষেরই; যেমন আক্রমণকারীর, তেমনি আক্রান্তের। তবে দুটি এক নয়। দুটি দুই ধরনের। বহুল ব্যবহৃত শব্দ দুটি ব্যবহার যদি অন্যায় না হয় তবে বলা যায় একটি প্রতিক্রিয়াশীল, অপরটি প্রগতিশীল।

প্রতিক্রিয়াশীল জাতীয়তাবাদ বহু অন্যায়ের জনক। সে সৃষ্টি করে সংকীর্ণতা ও অহমিকার। এর প্রভাবে মানুষ উগ্র হয়, আক্রমণকারী হয়। অন্যের দেশ দখল করে নিতে চায়। এর প্রভাবে মানুষ আচরণ করে নিকৃষ্ট বর্ণবাদীর। রক্তে রঞ্জিত হয় ভূমি; ক্ষতবিক্ষত হয় মানুষ। প্রতিক্রিয়াশীল জাতীয়তাবাদ উত্তেজিত করে রাখে মানুষকে, জাতির নামে। জাতির স্বার্থের কথা বলে, কিন্তু আসলে প্রতিষ্ঠা করে কতিপয়ের স্বার্থ, তাদের স্বার্থ, নেতা-রাজার মতো যাদের কর্তৃত্ব। তাদের এবং তাদের আশপাশে যারা থাকে লাভ হয় তাদের। তারা লুণ্ঠন করে। পারলে বাইরেও করে, কিন্তু অবশ্যই করে ভেতরে। আর রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে যে লুণ্ঠন, সেটা আড়াল করে রাখে তারা জাতীয়তাবাদের ভারী ও চটকদার চাদর টানিয়ে। ধনী, দরিদ্র নেই। বলা হয় সবাই সমান; সকলেই এক জাতি– ভাই ভাই। কিন্তু থাকে। ধনী-দরিদ্র আলাদা শ্রেণি হয়েই থাকে। কেবল থাকে না; ধনীরা আরও ধনী হয় দরিদ্রদের আরও দরিদ্র করে। এই জাতীয়তাবাদ অবশ্যই ঘৃণ্য, অতিঅবশ্য বিপজ্জনক।
এই উত্তেজক ও অন্ধ জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে যেসব কথা বলা হয়ে থাকে, তা যথার্থ। কিন্তু দোষটা জাতীয়তাবাদের নয়। মানুষের মধ্যে দুর্বৃত্ত রয়েছে, তাই বলে সকল মানুষ দুর্বৃত্ত নয়। আন্তর্জাতিকতা চমৎকার এক আদর্শ। স্থানের তো বটেই, কালের সীমাও লঙ্ঘন করার মধ্যে রয়েছে মানুষের মনুষ্যত্বের প্রমাণ। দর্শন, বিজ্ঞান, ধর্ম– সবই জাতীয়তাবাদবিরোধী। এরা ছড়িয়ে যেতে চায়।  শ্রমিক শ্রেণির ঐক্য দরকার। দুনিয়ার মজদুর এক হও– এ খুবই যথার্থ রণধ্বনি। কিন্তু শ্রমিকও তো ভূমিতেই থাকে।

তার উৎপাটিত গৃহহীন ভাসমান দশাটি কোনো আদর্শ অবস্থা নয়। শ্রমিক তার ব্যক্তিগত সম্পত্তির ওপর দাঁড়িয়ে না-থাকুক, তাকে নিশ্চয় দাঁড়াতে হবে একটি ব্যবস্থার ওপর ভর করে। সেই ব্যবস্থাটাই সে চায়। যে ব্যবস্থা তাকে নিরাপত্তা দেবে। দেবে আশ্রয়। নিশ্চিত করবে তার চাহিদাগুলোর সরবরাহ। শ্রমিকের ঐক্যের একটি আন্তর্জাতিক চরিত্র আছে। কিন্তু শুরু করতে হয় দেশেই; রাষ্ট্রের অভ্যন্তরেই।

সোভিয়েত ইউনিয়ন একটি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিল। ব্যবস্থাটা জাতীয়তাবাদী নয়; সমাজতান্ত্রিক। জাতীয়তাবাদী ব্যবস্থা বলে কোনো সামাজিক ব্যবস্থা নেই। আছে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা, সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা। সোভিয়েত ইউনিয়নের ওই ব্যবস্থার ভেতরে বিভিন্ন জাতিসত্তা একত্রে মিশতে পেরেছিল। কারণ সেখানে শোষণ ছিল না। এক জাতিসত্তা আধিপত্য স্থাপন করতে চায়নি অন্য জাতিসত্তার ওপর; সাম্য ছিল পারস্পরিক। ওই সাম্যটা প্রয়োজন। কিন্তু এমনকি সেই ব্যবস্থাও টেকেনি। বৈষম্য মাথাচাড়া দিয়ে উঠছিল, ভেতরে ভেতরে। যে জন্য বলতে হয়, সমাজ ব্যবস্থা যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন সংস্কৃতির। সংস্কৃতিও স্থাবর কোনো বস্তু নয়। তাকে প্রবহমান রাখতে হয়, নইলে চড়া পড়ে নষ্ট হয়ে যায়। আর সেখানেই আসে কর্মপ্রবাহের কথা। কাজের স্রোত দরকার। কাজ জীবিত রাখবে সংস্কৃতিকে; টিকিয়ে রাখবে ব্যবস্থাকে। কাজ না থাকলে বেকার হবে অনেক, অলস হবে অন্যরা। কাজই বিশ্রামের সৃষ্টি করে। বিশ্রামের কাজ নয় কাজ সৃষ্টি করা।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
দেশকন্ঠ/এআর

  মন্তব্য করুন
আরও সংবাদ
×

আমাদের কথা

ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বব্যাপী অনলাইন মিডিয়া। গতি ও প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে মানুষও তথ্যানুসন্ধানে নির্ভরযোগ্য মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছে অনলাইন। যতই দিন যাচ্ছে, অনলাইন মিডিয়ার সঙ্গে মানুষের সর্ম্পক তত নিবিড় হচ্ছে। দেশ, রাষ্ট্র, সীমান্ত, স্থল-জল, আকাশপথ ছাড়িয়ে যেকোনো স্থান থেকে ‘অনলাইন মিডিয়া’ এখন আর আলাদা কিছু নয়। পৃথিবীর যে প্রান্তে যাই ঘটুক, তা আর অজানা থাকছে না। বলা যায় অনলাইন নেটওয়ার্ক এক অবিচ্ছিন্ন মিডিয়া ভুবন গড়ে তুলে এগিয়ে নিচ্ছে মানব সভ্যতার জয়যাত্রাকে। আমরা সেই পথের সারথি হতে চাই। ‘দেশকণ্ঠ’ সংবাদ পরিবেশনে পেশাদারিত্বকে সমধিক গুরুত্ব দিয়ে কাজ করতে বদ্ধপরির। আমাদের সংবাদের প্রধান ফোকাস পয়েন্ট সারাবিশ্বের বাঙালির যাপিত জীবনের চালচিত্র। বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের সংবাদও আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা একঝাক ঋদ্ধ মিডিয়া প্রতিনিধি যুক্ত থাকছি দেশকণ্ঠের সঙ্গে।