হকিতে ভারতবর্ষ ১৯২৮ থেকে ১৯৫৬ বিশ্বকে তার ইচ্ছা মতন শাসন করেছে। এ সময় ভারতীয় দলে ছিলেন ধ্যানচাঁদ। মেজর ধ্যানচাঁদ তার স্টিকের কারুকার্য দিয়ে মোহিত করেছেন বিশ্ব হকিজগত। ভারতের সাথে পাকিস্তান ও হকিতে প্রভাব বিস্তার করে, এদের জয়ধারাকে রোধ করার পরিকল্পনা শুরু করে। এর পর ইউরোপ আর অস্ট্রেলিয়া। ১৯৭৬ সনের মন্ট্রিল অলিম্পিকে পেয়ে যায় কাঙ্খিত সমাধান। কানাডাতে রাগবি খেলা হয় ‘আর্টেফিসিয়াল টার্ফে’, প্রচণ্ড শীতে কানাডার মাঠ সব ভীষণ শক্ত হয় এজন্য কৃত্রিম ঘাসের মাঠ ব্যবহার করা হয়। অলিম্পিকের জন্য নির্দ্ধারিত হকি মাঠ গুলিও শীতে শক্ত হয়ে রয়েছে সুতরাং আন্তর্জাতিক হকি সংস্থা কৃত্রিম মাঠ ব্যবহার করার স্বিদ্ধান্ত নিল। পাক-ভারতের ছ্বন্দের হকি, দারুণ কারুকার্যময় গতিশীল হকি বিদায় নিল, হিট এন্ড রান-এর জগতে প্রবেশ করল হকি।
এই কৃত্রিম মাঠ প্রচুর খরচের। বাসায় ব্যবহার করা কার্পেটের মতন এই মাঠ বিধানের আগে পুরো মাঠ পাথরের টুকরো, বালি দিতে হয়। মাঠে খেলার শুরুতে ঢালতে হয় চারহাজার গ্যালন পানি আবার হাফ টাইমে ঢালতে হয় দু’হাজার গ্যালন পানি। মাঠের সাথে তাই প্রায় সাড়ে সাত শত ফুট গর্ত করে রিজয়ভার রাখতে হয়।
বালি, কয়লা, কর্ক এমনভাবে দিতে হয় যাতে সব সময় কৃত্রিম ঘাস গুলো পানিতে ভিজে থাকে আর অতিরিক্ত পানি চলে যাবার ব্যবস্থা থাকে।এ মাঠে স্বাভাবিক ঘাঁসে খেলার প্রথম তফাত হলো কৃত্রিম মাঠে সারাক্ষণ ফ্লাট ফুটেডভাবে খেলতে হয়, যাতে কাফ মাসেলের উপর প্রচণ্ড চাপ পরে, এ জন্য ওয়ান টাচ হকি হলো শ্রেষ্ঠ সমাধান। শারীরিকভাবে সমর্থ এবং শক্তিশালী লোয়ার পর্সনওয়ালারা সফল এ মাঠে।
মাঠ একদম মসৃন থাকাতে অকারণ বল পায়ে লাগার সম্ভাবনা কম ফলে খেলা বন্ধ হয়না আর বন্ধ না হবার কারনে মাঠে’রেষ্ট’ পাওয়া দুস্কর তাই দরকার অফুরন্ত দম। এ মাঠে ‘ স্টেমিনা, স্পিড, স্কিল ‘ এই তিন ‘S’ এর চূড়ান্ত ব্যবহার হলো ‘ ফার্স্ট প্রাওরিটি’। ঘাসের মাঠে বল হঠাৎ লাফিয়ে উঠে শরীরে লেগে ফাউল হতেই পারে এবং আম্পায়ারের বাশি খেলা ক্ষণে ক্ষণে বন্ধ হয়। এস্টো টার্ফে এ সম্ভাবনা নেই বল্লেই চলে।
এই কৃত্রিম মাঠ মন্ট্রিল অলিম্পিক হকিতে ব্যবহারের ফলে পাক-ভারতের জয় জয়কার স্থিমিত হয়ে যায়। আন্তর্জাতিক হকি সংস্থা (এফ আই এইচ) কোন আন্তর্জাতিক খেলা কৃত্রিম মাঠ ব্যতীত অনুমোদন দেয় না। প্রথম দিকে কৃত্রিম মাঠ প্রায় দশকোটি উপর হলেও এখন ৩/৪ কোটিতে পাওয়া যায়। তবে এ মাঠ ‘LAY’ করতে ও খরচ আছে আর প্রতি নিয়ত পরিচর্যা ব্যতীত এ মাঠ থেকে স্বাভাবিক প্রতিদান পাওয়া নৈবচ্য।
আমাদের দেশে হকি স্টেডিয়ামে যে কৃত্রিম মাঠ আছে কা পরিবর্তনের সময় এসেছে। বিশ্ব দরবারে হকি তে সম্মান আদায় করতে হলে আমাদের অন্তত দশটা টার্ফ দরকার। শুধু ঢাকাতে টার্ফ না রেখে জেলাতে টার্ফ বসানোর ব্যবস্থা হলো এ সময়ের সব থেকে বড় আবেদন।
১৯০৮ সনে নবাব স্যার সলিমুল্লাহ কোলকাতার ‘হেয়াইট ওয়েজ’ ডিপার্টমেন্টাল স্টোর থেকে হকি স্টিক নিয়ে আসেন নবাব বাড়ির উঠতি যুবকদের জন্য, ঢাকাতে হকির সেই শুরু। নবাব বাড়ির ইউসুফ রেজা ‘চ্যান্স’ পেয়েছিল ধ্যানচাদের অলিম্পিক দলে তবে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের জন্য অলিম্পিক না হওয়াতে ইউসুফ রেজা সম্ভাব্য গোল্ড মেডেল বঞ্চিত হয়।
হকির কথা বলতে গেলে আমাদের হকি তারকা আব্দুস সাদেকের নাম আসবেই। পাকিস্তান হকি দলের এই নিয়মিত হকি খেলোয়াড় ঢাকা মাঠে ১৯৭০ সনে পূর্ব পাকিস্তান বনাম পাকিস্তান হকিদলের খেলাতে খেলেছিলেন পুর্ব পাকিস্তান দলের অধিনায়ক হয়ে। পাকিস্তান জিতেছিল সর্ট কর্নার স্পেসিয়াল্ষ্ট তানভির দারের একমাত্র গোলে। দর্শকেমাঠ ছিল ভরা। আব্দুস সাদেক তার স্টি কের নৈপুন্যে একাই কোনঠাসা করে রেখে ছিল পাকিস্তান দলকে। পাকিস্তান জাতীয় দলে কখনো কোন বাংগালি নেই। ১৯৭০ সনে পুরো পূর্ব পাকিস্তান টগবগ করে জ্বলছে বৈষ্যমের আগুনে। সাদেকের খেলা দেখার পর বাংগালির হুন্কার ‘এখানেও বৈষম্য। পাকিস্তান দল বাধ্য হলো আব্দুস সাদেক কে পাকিস্তান দলে নিতে। ১৯৮৫ সনে এশিয়া কাপ হকিতে পাকিস্তান জিতেছিল বাংলাদেশের সাথে ১-০ গোলে। সমানে সমানে টক্কর ছিল পুরো খেলা জুড়েই। দর্শকে পরিপূর্ণ ছিল ঢাকা স্টেডিয়াম। এখন হকি মাঠ খা খা করে দর্শকের অভাবে।
দর্শকরা হকি মাঠ বিমুখ কেন? ফেডারেশন কর্তারা গবেষণা করুন প্লিজ। ঢাকার হকির ইতিহাস একশ বছর পার করেছে। শত বর্ষ হকি- নিয়ে একটা আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট করার যেতেই পারে। দায়িত্বশীলরা এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে পারেন। হকিতে আমাদের দেবার অনেক কিছু আছে। অভাব হলো দেবারা রাস্তা মসৃন করতেকে এগিয়ে আসবে?
লেখক : সাবেক অধিনায়ক জাতীয় ও সেনাবাহিনী হকি দল এবং জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারপ্রাপ্ত।
দেশকণ্ঠ/আসো