দেশকন্ঠ প্রতিবেদন : প্রস্তাবিত ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের বাজেটে বেশ কিছু পণ্যে শুল্ক আরোপ বা আগের চেয়ে বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এর ফলে দামি গাড়ি, বাইসাইকেল, নির্মাণ সামগ্রী, জমি ও ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রেশন, সিগারেট, বাসমতি চাল, কাজুবাদাম, সোনা, খেজুর, সিমেন্ট, রড, বিদেশি আঠা বা গ্লু , ভ্রমণ খরচ, প্লাস্টিকের গৃহস্থালি পণ্য, ফ্রিজ, ফ্যান ও এক্সেলেটর, টেবিলওয়্যার, কিচেনওয়্যার, টিস্যু, ন্যাপকিন, কোমল পানীয়, ওভেন, কলম, চশমা ও এলপিজি সিলিন্ডারের দাম বাড়তে পারে। বৃহস্পতিবার (১ জুন) বিকেল ৩টায় জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপন করেন। যা চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ১ লাখ ১ হাজার ২৭৮ কোটি টাকা বেশি। এটি স্বাধীন বাংলাদেশের ৫২তম বাজেট। এছাড়া আওয়ামী লীগ সরকারের তিন মেয়াদের ১৫তম বাজেট এটি। অর্থমন্ত্রী হিসেবে আ হ ম মুস্তফা কামালেরও টানা পঞ্চম বাজেট।
বাজেট প্রস্তাবনায় কোন কোন পণ্যের ওপর কী পরিমাণ শুল্ক আলোপ করা হয়েছে বা কোন কোন পণ্যের শুল্ক বাড়ানো হয়েছে তা তুলে ধরেন অর্থমন্ত্রী। এবারের বাজেটের প্রতিপাদ্য ধরা হয়েছে ‘উন্নয়ন অগ্রযাত্রার দেড় দশক পেরিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশের অভিমুখে।’ যেখানে মূল লক্ষ্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধরে রাখাসহ সামষ্টিক অর্থনৈতিক অবস্থায় ভারসাম্য রক্ষা। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে প্রস্তাবিত বাজেটে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে বিভিন্ন সুবিধা দিচ্ছে, পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা সুরক্ষায় বিলাসবহুল পণ্যে আমদানি নিরুৎসাহিত করছে। বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেন, এ বাজেটে সামগ্রিক ঘাটতি (অনুদান ব্যতীত) ধরা হচ্ছে ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৫ দশমিক ২০ শতাংশের সমান। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে সামগ্রিক ঘাটতি ধরা হয় ২ লাখ ২৭ হাজার ৫০৭ টাকা, যা জিডিপির ৫ দশমিক ১০ শতাংশ।
অনুদানসহ আগামী অর্থবছরের বাজেটে ঘাটতি ধরা হচ্ছে ২ লাখ ৫৭ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে অনুদানসহ সামগ্রিক ঘাটতি ধরা হয় ২ লাখ ২৪ হাজার ২৪৪ কোটি টাকা। ঘাটতি মেটাতে বৈদেশিক ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ১ লাখ ২৭ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। বিপরীতে ২৪ হাজার ৭০০ কোটি টাকা বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে। তাতে নিট বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে ১ লাখ ২ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা। এছাড়া বৈদেশিক অনুদান পাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকা ধরা হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে বৈদেশিক অনুদান ধরা হয় ৩ হাজার ২৬৩ কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ১ হাজার ৫৫ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা ধরা হচ্ছে। এর মধ্যে ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হবে। যার মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ৮৬ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা ও স্বল্পমেয়াদি ঋণ ৪৫ হাজার ৮১৫ কোটি টাকা।
এছাড়া ব্যাংক বহির্ভূত ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ২৩ হাজার কোটি টাকা ধরা হচ্ছে। সঞ্চয়পত্র থেকে ১৮ হাজার কোটি টাকা নেওয়া হবে ও অন্যান্য খাত থেকে ৫ হাজার টাকা ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে। নতুন অর্থবছরের বাজেটে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ৫ লাখ কোটি টাকা নির্ধারণ করেছেন অর্থমন্ত্রী। এর মধ্যে কর বাবদ ৪ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা ও কর ছাড়া ৫০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে। কর বাবদ যে রাজস্ব আসবে তার মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) নিয়ন্ত্রিত কর ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। আর জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বহির্ভূত কর ২০ হাজার কোটি টাকা।
যেসবের পণ্যের দাম বাড়তে পারে
মোবাইল ফোন : স্থানীয় উৎপাদন ও সংযোজন পর্যায়ে মোবাইল ফোনের ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে। তাই মোবাইল ফোনের দাম বাড়তে পারে।
এলপি গ্যাস : উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে। একইসঙ্গে সিলিন্ডার বানানোর কাজে ব্যবহৃত স্টিল ও ওয়েল্ডিং ওয়্যার আমদানিতে শুল্ক আরোপ হয়েছে। এ কারণে এলপি গ্যাসের দাম বাড়তে পারে।
কলম : কলম উৎপাদনে বর্তমানে ভ্যাট অব্যাহতি ছিল, সেখানে ১৫ শতাংশ ভ্যাট বসানো হয়েছে। এতে শিক্ষা উপকরণ কলমের দাম বাড়তে পারে।
চশমার ফ্রেম : চশমার ফ্রেম ও সানগ্লাস আমদানিতে শুল্ক ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করা হচ্ছে। এছাড়াও উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হচ্ছে। তাই বাড়তে পারে চশমার ফ্রেমের দামও।
সাইকেল : সাইকেলের যন্ত্রাংশ আমদানিতে শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। তাই সাইকেলের দাম বাড়তে পারে।
থালা-বাসন : প্লাস্টিকের তৈরি থালা, বাটি ও অন্যান্য পণ্যের ভ্যাট আড়াই শতাংশ বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে। টিফিন বক্স ও পানির বোতলে ভ্যাট আগের মতো থাকবে। অ্যালুমিনিয়ামের থালা-বাসন ও রান্নাঘরের সরঞ্জামের ভ্যাট একই হারে বাড়ানো হয়েছে।
প্লাস্টিক ও অ্যালুমিনিয়ামের তৈজসপত্র : বাসাবাড়িতে ব্যবহৃত প্লাস্টিক ও অ্যালুমিনিয়ামের তৈজসপত্র উৎপাদনে ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হয়েছে। এতে তৈজসপত্রের দাম বাড়তে পারে।
টিস্যু পেপার : কিচেন টাওয়াল, টয়লেট টিস্যু, ন্যাপকিন টিস্যু, ফেসিয়াল টিস্যু/পকেট টিস্যু ও পেপার টাওয়াল উৎপাদনে ৫ শতাংশ ভ্যাট আছে, এটি বাড়িয়ে ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হচ্ছে। এতে টিস্যু পেপারের দাম বাড়তে পারে।
মাইক্রোওয়েভ ওভেন : শুল্ক ফাঁকি রোধে মাইক্রোওয়েভ ওভেন আমদানির শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। এতে বিদেশি ওভেনের দাম বাড়তে পারে।
বাসমতি চাল : নন ফর্টিফাইড বাসমতি চাল আমদানিতে ভ্যাট বসানো হয়েছে। এতে এই চালের দাম বাড়তে পারে।
খেজুর: শুল্ক-ফাঁকি রোধে তাজা ও শুকনো খেজুর আমদানিতে ২৫ শতাংশ শুল্কের পাশাপাশি ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। এতে খেজুরের দাম বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
কাজুবাদাম : স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদন বাড়াতে কাজুবাদাম আমদানিতে শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। এ কারণে আমদানি করা কাজুবাদামের দাম বাড়তে পারে। এছাড়াও ফল-বাদাম আমদানিতে ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।
সিগারেট: এবারও সিগারেটের মূল্যস্তর বাড়ানো হয়েছে। কাজেই সব ধরনের সিগারেটের দামই বাড়তে পারে।
বিলাসবহুল গাড়ি : ২০০০ সিসির ঊর্ধ্বের গাড়ি আমদানিতে সম্পূরক শুল্ক ব্যাপক হারে বাড়ানো হয়েছে। তাই উচ্চ সিসির গাড়ি কেনার খরচ বাড়বে।
তরল নিকোটিন
তামাকজাতীয় পণ্য যেমন তরল নিকোটিনের ওপর ১৫০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। ইলেকট্রনিক সিগারেট ও সমজাতীয় ইলেকট্রিক ভ্যাপোরাইজার ডিভাইসের যন্ত্রাংশের শুল্কহার বাড়িয়ে মূল পণ্যের সমান, ২১২ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। ফলে ভ্যাপোরাইজারের দাম বাড়বে। এটি সাধারণভাবে ভ্যাপ নামে পরিচিত।
সিমেন্ট : সিমেন্টের প্রধান কাঁচামাল ক্লিংকার আমদানিতে বর্তমানে টনপ্রতি ৫০০ টাকা সুনির্দিষ্ট শুল্ক আছে। এটি বাড়িয়ে ৭০০ টাকা করা হয়েছে বিধায় সিমেন্টের দাম বাড়তে পারে।
বাইসাইকেল
বাইসাইকেলের কিছু যন্ত্রাংশের আমদানি শুল্ক ৫ বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। এতে বিদেশি যন্ত্রাংশ ব্যবহারকারী বাইসাইকেলের উৎপাদন ব্যয় বাড়বে।
আঠা
আঠা (অ্যাডহেসিড/গ্লু) আমদানিতে ১৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এতে বিদেশি আঠার দাম বাড়বে।
সফটওয়্যার
সফটওয়্যার ও কাস্টমাইজেশন সেবার ওপর ৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। এতে এই সেবার মূল্য বাড়তে পারে। বিদেশি কিছু সফটওয়্যারের ওপর ৫ শতাংশ শুল্ক রয়েছে। অন্য ক্ষেত্রে হারটি ২৫ শতাংশ। শুল্ক ফাঁকি রোধে হারটি সব ক্ষেত্রে ২৫ শতাংশ করা হয়েছে। ১৫ শতাংশ ভ্যাটও বসবে।
বিদেশি লিফট
দেশীয় শিল্পকে সুরক্ষা দিতে লিফটের সরঞ্জামের আমদানিশুল্ক ৫ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে বিদেশি লিফটের দাম অনেকটাই বেড়ে যেতে পারে। শুল্ক ১ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৫ শতাংশ হবে চলন্ত সিঁড়ি বা এস্কেলেটর আমদানিতে।
বিদেশি স্যান্ডউইচ প্যানেল
স্যান্ডউইচ প্যানেল ভবনে ব্যবহার করা হয় তাপ ও শব্দপ্রতিরোধক হিসেবে। পণ্যটি মূলধনি যন্ত্রপাতি হিসেবে রেয়াতি সুবিধায় মাত্র ১ শতাংশ আমদানি শুল্ক পরিশোধ করে আমদানির সুযোগ রয়েছে। বাজেট প্রস্তাবে বলা হয়েছে, পণ্যটি কোনো মূলধনি যন্ত্রপাতি নয়। দেশে এটি তৈরি হয়। তাই দেশীয় উৎপাদনে উৎসাহিত করতে পণ্যটির আমদানি শুল্ক বাড়িয়ে ৫ শতাংশ নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে।
সাধারণ ইট
যন্ত্রের সাহায্য ছাড়া তৈরি সাধারণ ইটে ভ্যাট (নন-রিফ্লেকটরি বিল্ডিং ব্রিকস) প্রতি হাজারে ৪৫০ থেকে বাড়িয়ে ৫০০ টাকা করা হয়েছে। এটা ‘ফেসিংয়ে’ ব্যবহৃত ইটের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। এছাড়াও দাম বাড়তে পারে শিরিষ কাগজ, আঠা বা গ্লু, মাছের টুকরা, চিজ ও দই, চা-কফিমেট, গ্যাস লাইটার প্রভৃতি পণ্যের।
দেশকন্ঠ/অআ