দেশকন্ঠ প্রতিবেদন : এই মুহূর্তে দেশে-বিদেশে আমেরিকার সম্মিলিত ঋণের পরিমাণ ৩১.৪ লক্ষ কোটি ডলার। তাদের আয়ের চেয়ে ব্যয় অনেক বেশি। বাড়তি টাকা আসে ঋণ থেকেই। পৃথিবীর অনেক দেশই আমেরিকার থেকে অনেক টাকা পায়। অথচ বিশ্ব অর্থনীতির শীর্ষে আমেরিকা। ডলারের জোরে যারা সারা বিশ্বের উপর ছড়ি ঘোরায়। সেই দেশই দেউলিয়া হতে বসেছে! আমেরিকার অর্থের ভান্ডার ঠেকেছে তলানিতে।
আমেরিকার অর্থনীতি যে সঙ্কটের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে, তার নেপথ্যে অন্যতম কারণ আয় এবং ব্যয়ের মধ্যে ভারসাম্য না থাকা। যার ফলে পাহাড়প্রমাণ ঋণের বোঝা চেপেছে বাইডেন সরকারের ঘাড়ে। মূলত, কোভিড অতিমারি এবং তার পরবর্তী সময়ে দেশ সচল রাখতে আমেরিকার যে নীতি, তা-ই দেশটিকে খাদের কিনারায় এনে দাঁড় করিয়েছে। পরিস্থিতি এতই উদ্বেগের যে, স্বয়ং প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে দেশ এবং বিশ্বের স্বার্থে বিরোধীদের দ্বারস্থ হতে হয়েছে। আমেরিকা বরাবরই আয়ের চেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করে থাকে। এই বাড়তি অর্থ আসে ঋণ থেকে। বিভিন্ন দেশ এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে আমেরিকার ঋণ রয়েছে। গত কয়েক বছরে সেই ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে হু হু করে।
সরকারি নীতি অনুযায়ী আমেরিকার জন্য ঋণ গ্রহণের ঊর্ধ্বসীমা বেঁধে দেওয়া আছে। অর্থাৎ, হোয়াইট হাউস চাইলেই ইচ্ছামতো ঋণের পরিমাণ বাড়িয়ে ফেলতে পারে না। চলতি বছরের গোড়াতেই সেই ঋণের ঊর্ধ্বসীমা ছুঁয়ে ফেলেছে বাইডেন সরকার। বর্তমানে দেশে-বিদেশে আমেরিকার সম্মিলিত ঋণের পরিমাণ ৩১.৪ লক্ষ কোটি ডলার। এ দিকে, সরকারের হাতে টাকাও নেই। প্রশাসন এবং অর্থনীতিকে সচল রাখতে তাই আরও ঋণের প্রয়োজন।
আগামী বছর আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। তাই রাজনৈতিক কারণে এই মুহূর্তে করবৃদ্ধি সম্ভব নয়। সরকারের ব্যয়ও কমার কোনও সম্ভাবনা নেই। এই পরিস্থিতিতে সরকারের ঋণ নেওয়ার ঊর্ধ্বসীমা বৃদ্ধি করার জন্য ডেমোক্র্যাট নেতা বাইডেন বিরোধী রিপাবলিকানদের সহায়তা চেয়েছিলেন। দেশের স্বার্থে ডেমোক্র্যাট এবং রিপাবলিকানরা একজোট হয়ে ঋণসীমা বৃদ্ধির প্রস্তাবে সায় দিয়েছে। আপাতত হাউসে ৩১৪-১১৭ ভোটের ব্যবধানে গৃহীত হয়েছে বাইডেনের প্রস্তাব। এ বার এই বিল যাবে উচ্চকক্ষ সেনেটে। আমেরিকায় সরকার এবং বিরোধীরা পরস্পরের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সঙ্কটমুক্তির উপায় বার করেছেন। তাই এ যাত্রায় বেঁচে গিয়েছে ওয়াশিংটন। আমেরিকাকে শ্রীলঙ্কা হতে হয়নি। কিন্তু কেন এই পরিস্থিতি এল?
পরিসংখ্যান বলছে, শুধুমাত্র সরকারকে সচল রাখার জন্যই আমেরিকাকে প্রতি দিন ১.৭ হাজার কোটি ডলার খরচ করতে হয়। কর ইত্যাদি থেকে সরকারের এত আয় হয় না। ১৯৬০ সাল থেকে এখনও পর্যন্ত ৭৮ বার আমেরিকা নির্ধারিত ঋণের ঊর্ধ্বসীমা ছাপিয়ে গিয়েছে। প্রতি ক্ষেত্রেই অর্থনৈতিক অচলাবস্থা কাটাতে শাসক এবং বিরোধীদের একজোট হয়ে ঋণসীমা বৃদ্ধিতে সম্মত হতে হয়েছে। বাইডেন একা নন, পূর্বের প্রেসিডেন্টরাও সরকার চালাতে প্রচুর ঋণ নিয়েছেন। প্রেসিডেন্ট ওবামার আমলে সবচেয়ে বেশি ঋণ নেওয়া হয়েছিল। ঋণের পরিমাণ পৌঁছেছিল ৭.৬ লক্ষ কোটি ডলারে। তার পর ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে নেওয়া হয় ৬.৭ লক্ষ কোটি ডলার।
আমেরিকা বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনৈতিক কাঠামোর অধিকারী। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী ঋণ গ্রহণের সীমা বেঁধে দেওয়া হলেও আসলে হোয়াইট হাউসের তেমন কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। তারা যত খুশি ঋণ নিতে পারে। কারণ, বিশ্ব অর্থনীতির পরিচালক মুদ্রা ছাপে তারাই। বিশ্ব জুড়ে যত বাণিজ্য হয়, তার ৮০ শতাংশে ব্যবহৃত হয় আমেরিকান ডলার। যে দেশ নিজস্ব পণ্য বিক্রি করে যত ডলার আয় করে, তা তারা আবার আমেরিকাতেই বিনিয়োগ করে। ফলে আমেরিকার খরচ করা ডলার ফিরে যায় আমেরিকাতেই। সেই কারণেই এই দেশের অর্থনীতি এত সুরক্ষিত। আমেরিকার এই মুহূর্তের ৩১.৪ লক্ষ কোটি ডলারের ঋণের ২৫ শতাংশ অন্যান্য দেশের অধীন। আমেরিকার কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি টাকা পায় জাপান। তাদের কাছে ঋণ প্রায় ১.১ লক্ষ কোটি ডলার। তার পরেই ঋণের তালিকায় রয়েছে চিন। তারা পায় ৮৬ হাজার কোটি ডলার। ভারত আমেরিকার কাছ থেকে পায় ২৩.২ হাজার কোটি ডলার।
কৌতূহলের বিষয় হল, আমেরিকা বার বার এই অর্থনৈতিক সঙ্কটের মুখে দাঁড়ায়। বিপুল ঋণের বোঝায় নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড় হয় হোয়াইট হাউসের। কিন্তু তার পরেই তারা ঋণ গ্রহণের ঊর্ধ্বসীমা বৃদ্ধি করে। এ ক্ষেত্রে তাদের কারও কাছে জবাবদিহি করতে হয় না। তাই আজ পর্যন্ত আমেরিকার অর্থনীতি কখনও শ্রীলঙ্কা বা পাকিস্তানের মতো পুরোপুরি ধসে যায়নি। কোভিড অতিমারির সময় বিশ্ব জুড়ে মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছিলেন। ২০২০ সালের ওই এক বছরে আমেরিকা রাতারাতি ৩ লক্ষ কোটি ডলার ছেপে ফেলেছিল। তা দেশের নাগরিকদের মধ্যে সরকার বিলিয়ে দেয়। এর ফলে, আমেরিকায় কারও তেমন টাকার অভাব হয়নি অতিমারিতেও।
কিন্তু সরকারের এই নীতির সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাব অবশ্যম্ভাবী। আমেরিকার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। বেশি মুদ্রা ছেপে মানুষ বেশি টাকার অধিকারী হন ঠিকই, কিন্তু বাজারে প্রয়োজনীয় দ্রব্যের পরিমাণ তাতে কমে আসে। চাহিদা বেড়ে যায়, জোগান তার সঙ্গে মেলে না। ফলে আমেরিকার রাস্তায় সাধারণ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে যায়। মানুষের কাছে টাকা থাকে, কিন্তু দোকানে জিনিস নেই। আমেরিকার এই অর্থনৈতিক পরিস্থিতির প্রভাব পড়বে বাকি দেশগুলিতে। এর ফলে স্টক মার্কেটে ধস নামবে, ঋণ গ্রহণের মাধ্যমেই অন্য দেশের উপর লগ্নিকারীদের চাপ বৃদ্ধি পাবে। সরকারি চাকুরিজীবী, সামরিক বাহিনীর বেতনে টান পড়বে সবার আগে। সর্বোপরি আমেরিকার ভাবমূর্তি বড়সড় ধাক্কা খাবে বিশ্বের বাজারে। তবে পরিস্থিতি সামাল দেবে হোয়াইট হাউস।
আমেরিকার পরিস্থিতি থেকে ভারত এবং বাকি দেশগুলির শিক্ষা নেওয়া উচিত। কারণ, বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনীতি হওয়ায় আমেরিকা পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার যে সুযোগ পেয়ে থাকে, অন্যেরা তা পাবে না। ভারতেও একাধিক ক্ষেত্রে আমেরিকার ‘ভুল’ নীতির প্রতিফলন দেখা গিয়েছে। বিভিন্ন রাজ্যে রাজনৈতিক দলগুলি ভোটে জেতার আশায় সাধারণ মানুষকে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা এবং ঢালাও সুযোগ-সুবিধার লোভ দেখায়। কিন্তু ক্ষমতায় এলে সেই প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কাজ করার মতো টাকার জোগান দিতে পারে না। বিনামূল্যে বিদ্যুৎ বা পরিবহণ বৃহত্তর ক্ষেত্রে আদতে সাধারণ মানুষ তথা দেশের অর্থনীতিরই লোকসান।
আমেরিকার মতো ঋণ নিয়ে নিয়ে অর্থনীতিকে সচল রাখা আদৌ কোনও সমাধান নয়। ঋণের আক্ষরিক অর্থ ভবিষ্যতের আয় থেকে অর্থ চুরি করা। তাই ভারত-সহ বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশগুলির উচিত তাৎক্ষণিক সুখের চিন্তা না করে আরও ভেবেচিন্তে অর্থনৈতিক নীতি স্থির করা।
দেশকণ্ঠ/আসো
সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা