দেশকন্ঠ অনলাইন : শক্তির বিচারে না হলেও চরিত্রের দিক থেকে ঘূর্ণিঝড় রেমাল ছিল ব্যতিক্রম। ধীর গতিতে এটির স্থলভাগে এগিয়ে আসাকে স্বাভাবিক মনে করছেন না বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে সাম্প্রতিক সময়ে ঘূর্ণিঝড়গুলোর গতি কমে যাচ্ছে। আর এতে আরও বেশি শক্তি সঞ্চয় করে উপকূলে আঘাত হানছে। তারা বলছেন, ভবিষ্যৎ বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হওয়া ঘূর্নিঝড়গুলো বেশি শক্তিশালি হবে ও সেগুলোর ক্ষতিকর প্রভাবও অনেক বেশি হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
কানাডার সাসকাচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ে আবহাওয়া ও জলবায়ুবিষয়ক পিএইডি গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশ বলেন, ২২ মে দক্ষিণ মধ্য বঙ্গোপসাগরে একটি লঘুচাপ সৃষ্টি হয় যা পর্যায়ক্রমে নিম্নচাপ, গভীর নিম্নচাপের স্তর পেরিয়ে ২৫ মে ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়। এটি রোববার রাত পৌনে ৯টার দিকে স্থলভাগে আঘাত হানতে শুরু করে। আমেরিকার জয়েন্ট টাইফুন ওয়ার্নিং সেন্টারের পূর্বাভাস অনুসারে, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে আজ সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত খুলনা, বরিশাল চট্টগ্রাম, ঢাকা ও রাজশাহী বিভাগে বাতাসের গতিবেগ ঘন্টায় প্রায় ৭৫ কিলোমিটার পর্যন্ত ছিল। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের আবহাওয়া পূর্বাভাস মডেল অনুসারে ঘূর্ণিঝড় রেমাল বাংলাদেশের স্থলভাগ পুরোপুরি অতিক্রম করতে মঙ্গলবার মধ্যরাত পর্যন্ত সময় নিতে পারে। ঘূর্ণিঝড়ের শক্তি হিসাবে কাজ করে সমুদ্রের গরম পানি। ফলে স্থলভাগে প্রবেশের পর-পরই ঘূর্ণিঝড় প্রয়োজনীয় শক্তির অভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় রেমালের ক্ষেত্রে কিছু ব্যতিক্রমী আচরণের কথা বলছে বেশিরভাগ আবহাওয়া পূর্বাভাস মডেল।
ব্যতিক্রমী আচরণ বিশ্লেষণ করে মোস্তফা কামাল পলাশ বলেন, প্রথমত, বিশ্বের বিভিন্ন আবহাওয়ার পূর্বাভাস মডেল বলছে- স্থলভাগে প্রবেশের পরও প্রায় ২৪ ঘণ্টা ঘূর্ণিঝড় শক্তি ধরে রাখে। দ্বিতীয়ত, দুই দিনের বেশি সময় নিয়ে বাংলাদেশের স্থলভাগ ত্যাগ করে ভারতের আসাম ও মেঘালয় রাজ্যে প্রবেশ করবে। তৃতীয়ত, বাংলাদেশের আটটি বিভাগেই রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা আছে। চতুর্থত, ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির প্রথম পর্যায় লঘুচাপ থেকে শুরু করে ঝড়ে পরিণত হওয়া পর্যন্ত রেমাল অস্বাভাবিক ধীর গতিতে (ঘন্টায় ১৩ কিলোমিটার) সামনে অগ্রসর হয়েছে। অথচ আগে ঘূর্ণিঝড়গুলো ঘণ্টায় ৪০ কিলোমিটার গতিতে আসতো। আবহাওয়া পূর্বাভাস মডেলগুলোতে এই বৈশিষ্ট্যগুলোকে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও জলবায়ুর পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বলা হচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় গবেষকরা বায়ুমণ্ডলে গ্রীনহাউস গ্যাস ও তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে ঘূর্ণিঝড়ের যে বৈশিষ্টগুলো পরিবর্তনের উল্লেখযোগ্য প্রমাণ পেয়েছেন, তা রেমালের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে।
মোস্তফা কামাল বলেন, জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে ঘূর্ণিঝড়গুলোর চলার গতি (অবহাওয়া বিজ্ঞানের ভাষায় ট্রান্স স্পিড) খুবই ধীর হবে। আমেরিকার জাতীয় আবহাওয়া সংস্থার বিজ্ঞানী জেমস ক্ষীণ ১৯৪৯ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন ঘূর্ণিঝড়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে প্রমাণ পেয়েছেন যে, ঘূর্ণিঝড়ের চলার গতিবেগ গড়ে প্রায় ১০ শতাংশ কমে গেছে। ঘূর্ণিঝড় স্থলভাগে প্রবেশের পরে চলার গতি ২০ শতাংশ কমেছে বিশ্বব্যাপী। চলার গতি কমে যাওয়ায় সমুদ্রের উপরে অবস্থান করার সময় অনেক বেশি পরিমাণে মেঘের সৃষ্টি করছে। স্থলভাগে পৌঁছানোর পরে সেই অতিরিক্ত মেঘ থেকে অতিরিক্ত পরিমাণে বৃষ্টিপাত ঘটাচ্ছে।
বিশ্বের অন্যতম প্রধান ঘূর্ণিঝড় গবেষক আমেরিকার এমআইটির ক্যারি ইমানুয়েল পরিচালিত ঘূর্ণিঝড় বিষয়ক অন্য গবেষণায় দেখা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ঘূর্ণিঝড়ের চলার গতিবেগ কমে যাওয়ার সাম্প্রতিক কালের ঘূর্ণিঝড়গুলোর প্রভাবে অনেক বেশি পরিমাণে বৃষ্টিপাত হচ্ছে।
আমেরিকার বিখ্যাত ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক জিন রেমন্ড পরিচালিত অন্য একটি গবেষণায় জানা গেছে, বায়ু দূষণের কারণে ঘূর্ণিঝড়ের চলার গতি কমে যায়। আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসায় কর্মরত বাংলাদেশি বিজ্ঞানী ফাহাদ আল আবদুল্লাহর গবেষণায় বলা হয়েছে, ভবিষ্যতে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হওয়া ঘূর্ণিঝড়গুলো বেশি শক্তিশালি হবে ও সেগুলোর ক্ষতিকর প্রভাব অনেক বেশি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
সমুদ্রবিষয়ক গবেষণা সংস্থা ন্যাশনাল ওশানোগ্রাফিক অ্যান্ড মেরিটাইম ইনস্টিটিউটের (নোয়ামি) নির্বাহী পরিচালক মোহন কুমার দাশ বলেছেন, ঝড় নিয়ে অবশ্যই আরও গবেষণা করা উচিত। দেশের ভবিষ্যৎ ঘূর্ণিঝড়গুলোর পূর্বাভাস দেওয়ার ক্ষেত্রে এই ঝড়ের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে হবে।
বুয়েটের বন্যা ও পানি ব্যবস্থাপনা ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক একেএম সাইফুল ইসলাম বলেন, এখন সমুদ্রের তাপমাত্রা যেভাবে বাড়ছে, তার যে প্যাটার্ন, হয়ত সে (ঘূর্ণিঝড়) এদিকে শক্তি বেশি পায়, মুভমেন্টটা সহজ হয়। তবে গবেষণা না করে বলা যাচ্ছে না। ঘূর্ণিঝড় একদিনের মধ্যেই তৈরি হয়ে উপকূলে আসছে। এর মানে, সমুদ্র থেকে অনেক বেশি শক্তি পাচ্ছে। এ কারণ বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে তাপমাত্রা অনেক বেড়ে যাচ্ছে।
দেশকন্ঠ//