দেশকণ্ঠ অনলাইন : ১৫ আগস্টে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরসহ ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় মানুষকে বিবস্ত্র করা থেকে গায়ে হাত তোলার মতো ঘটনাগুলো যারা ঘটিয়েছে, তারা মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে, বলেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক সারজিস আলম। সারজিস বলেছেন, ‘ধানমন্ডি ৩২–সহ ঢাকার বিভিন্ন স্থানে এমন অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে, যেগুলো আমাদের গণ-অভ্যুত্থানের স্পিরিটের সঙ্গে যায় না। এগুলো কোনোভাবেই আইনসংগত নয়।’ ১৬ আগস্ট সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অমর একুশে হল প্রাঙ্গণে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন সারজিস আলম। তিনি শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কোনো কর্তৃপক্ষ নয়; বরং একটি প্রেশার গ্রুপ।’
সারজিস আলম আরও বলেন, ‘ভাইরাল ভিডিওতে দেখেছি যে আমার বাবার বয়সী একজনকে কান ধরে ওঠবস করানো হচ্ছে, আমার বাবার বয়সী একজনকে বিবস্ত্র করা হয়েছে ও লোকজন যাচ্ছেতাই বলেছে, অসংখ্য মানুষের ফোন চেক করা হচ্ছে, আমার মায়ের বয়সী একজনের গায়ে হাত তোলা হয়েছে এবং সাংবাদিক ভাইবোনদের ওপর হামলার বিভিন্ন ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। এমন অসংখ্য অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে। গত ১৬ বছরের নির্যাতন-নিপীড়ন, কথা বলার অধিকার হরণ, দুর্নীতি-নিপীড়ন ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে—এগুলোর বিরুদ্ধেই ছিল আমাদের অভ্যুত্থান। আমরা এমন একটি বাংলাদেশ চেয়েছি, যেখানে সবাই সবার কথা বলতে পারবে, মতপ্রকাশ করতে পারবে, যে যে ধারায় বিশ্বাসী, সে অনুযায়ী কাজ করতে পারবে—এই স্বাধীনতাগুলো থাকবে। গতকাল আমরা এমন বেশ কিছু চিত্র দেখেছি, যে জায়গাগুলোতে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ছিল। আমরা জানি না, ওই শিক্ষার্থীরা কোন মতাদর্শ ধারণ করে, তাদের ডিফাইনও করতে পারব না।’
গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন প্ল্যাটফর্মের সবাই একসঙ্গে বসে আলোচনা করেছেন উল্লেখ করে সারজিস বলেন, ‘আমরা স্পষ্ট বলছি, আমরা খুঁজছি যে এসব ঘটনার সঙ্গে আমাদের কোনো সমন্বয়ক বা সহসমন্বয়ক যুক্ত আছেন কি না। আমাদের প্রথম সিদ্ধান্ত, তথ্য–প্রমাণের ভিত্তিতে পুরো বাংলাদেশে এসব ঘটনার সঙ্গে একজন সমন্বয়ক বা সহসমন্বয়কের যুক্ততা পাওয়া গেলে তাঁকে তাৎক্ষণিকভাবে আমাদের টিম থেকে বহিষ্কার করব। মানুষকে বিবস্ত্র করা থেকে গায়ে হাত তোলার মতো ঘটনাগুলো যারা ঘটিয়েছে, তারা মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে। এগুলো কোনোভাবেই আইনসংগত নয়। আমাদের দ্বিতীয় সিদ্ধান্ত হচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে যা করা প্রয়োজন, একটি প্রেশার গ্রুপ হিসেবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সেই কাজটি করবে। আমাদের যে দুজন ছাত্র-প্রতিনিধি অন্তর্বর্তী সরকারে আছেন, তাঁদের মাধ্যমে যেভাবে বিচার নিশ্চিত করা যায়, আমরা সেই কাজটি করব।’
সারজিস আলম বলেন, ‘আমাদের জায়গা থেকে স্পষ্ট বার্তা, ১৫ আগস্টে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে কেউ ফুল দিয়ে তাঁর শোক পালন করতে চায়, আমরা আমাদের জায়গা থেকে তাঁকে বাধা দিতে পারি না। স্বাধীন বাংলাদেশে যখন যে ক্ষমতায় এসেছে, তখন শুধু তার সুপ্রিম মানুষটিকে শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে, বাকিদের শ্রদ্ধা জানানো দূরের কথা, উল্টো ছোট করা হয়েছে। যাঁর যতটুকু সম্মান প্রাপ্য, ইতিহাসে যে জায়গাটুকু তাঁরা ধারণ করেন, তা তাঁদের দেওয়া হয়নি। বাংলাদেশের ইতিহাস নিয়ে কথা বললে যে মানুষগুলোর অবদান একদম অনস্বীকার্য, তাঁদের প্রত্যেককে তাঁদের অবদানের জন্য স্মরণ করতে হবে। কাউকে ইচ্ছাকৃতভাবে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ছোট করা যাবে না। শেখ মুজিবুর রহমানের যতটুকু সম্মান প্রাপ্য, তা তাঁকে দিতে হবে; একইভাবে জিয়াউর রহমানের যে সম্মান প্রাপ্য, তাঁকে তা দিতে হবে। এত বড় একটি গণ-অভ্যুত্থানের পরে দাঁড়িয়েও রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বাস্তবায়নের জন্য যখন নেতিবাচক কাজগুলো করা হয়, আমরা আমাদের জায়গা থেকে এগুলো কখনোই সমর্থন করি না। আমাদের মধ্যে যদি কেউ এ কাজগুলো করে থাকেন, তাঁদের বয়কট করা হোক।’
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে সারজিস বলেন, ‘বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী ধানমন্ডি ৩২-এ গিয়েছিলেন। তাঁর গাড়িতে হামলা-ভাঙচুর হয়েছে। কেন? তিনি যদি ওই রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাস করেন, তিনি সেখানে ফুল নিয়ে যেতে পারেন, আমরা বাধা দিতে পারি না। বরং আমরা যদি মনে করি, তিনি যে রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাস করেন, যে ব্যক্তিকে তিনি অনুসরণ করেন, তিনি অনুসরণযোগ্য নন, আমরা তাঁকে বয়কট করতে পারি। কিন্তু তাঁর গাড়িতে হামলা করা বা গায়ে হাত তোলার অথরিটি আমাদের কেউ দেয় না। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে আমরা সব জায়গায় বলেছি, যেটি ন্যায্য ও ন্যায়সংগত, সেটিই যেন বাস্তবায়ন হয়।’
আমরা কর্তৃপক্ষ নই
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে কিছু বার্তা দিয়েছেন সারজিস আলম। তিনি বলেন, ‘আমাদের স্পষ্ট বার্তা, যেখানে যখন পুলিশ, ট্রাফিক পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর টিম আসবে, তাদের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে ছাত্রসমাজকে সেখান থেকে সরে যেতে হবে। আপনাদের অবশ্যই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ক্লাসে ফিরে যেতে হবে।’ সারজিস স্পষ্ট করে বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এ ধরনের কোনো কিছুকে প্রমোটই করে না যে কেউ একজন কোনো একটি হোস্টেলে গিয়ে সার্চ করবে, কোনো একটি আবাসিক হোটেলে যাবে, কোনো একজন অধ্যাপককে জোর করে নামিয়ে দেবে। আমরা এগুলো সমর্থন করি না। আমরা কোনো অথরিটি নই। আমরা একটি প্রেশার গ্রুপ দুর্নীতিবাজ বা ক্ষমতার অপব্যবহারকারীদের অপসারণের জন্য আমরা দাবি তুলতে পারি, কিন্তু এটি করতে বাধ্য করতে পারি না।’
বিশাল একটি সুবিধাবাদী গোষ্ঠী ভুয়া সমন্বয়ক-সহসমন্বয়ক বা ভুয়া আন্দোলনকারী হয়ে উঠেছে মন্তব্য করে সারজিস আরও বলেন, তাঁরা তাঁদের জায়গা থেকে বিভিন্ন কমিটি তৈরি করছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা এমন খবরও পেয়েছি যে উত্তরা ১২ নম্বর সেক্টরে নাকি একটি কমিটি হয়েছে, যারা মসজিদে গিয়ে মসজিদ কমিটিকে পদত্যাগ করতে বলেছে। অথচ আমরা আমাদের জায়গা থেকে শুধু বিশ্ববিদ্যালয় বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানভিত্তিক কমিটি দিয়েছিলাম। ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য এবং কিছু রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য এই মানুষগুলো এমন কিছু কাজ করছে, যা অপ্রত্যাশিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটি স্থিতিশীল অবস্থায় আসার পর আমরা এই প্ল্যাটফর্মটির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব।’
বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে হামলার শিকার
১৫ আগস্ট উপলক্ষে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানাতে গেলে হামলার শিকার হন কেন্দ্রীয় মহিলা লীগের সাংস্কৃতিক বিষয়ক সম্পাদক ও অভিনেত্রী রোকেয়া প্রাচী। স্থানীয় গণমাধ্যমগুলোর খবরে বলা হয়েছে, পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী রোকেয়া প্রাচীর নেতৃত্ব ৭০-৮০ জন সংস্কৃতিকর্মী ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে মোমবাতি প্রজ্বালন করে। তাদের এই আয়োজন চলাকালে সেখানে ৩০-৪০ জনের মত যুবক লাঠিসোঁটা নিয়ে সেখানে উপস্থিত হয়। তারা হুমকি দিয়ে সবাইকে সরিয়ে দিয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি ভাঙচুর করে। এসময় রোকেয়া প্রাচী সেটি ঠিক করতে গেলে লাঠি দিয়ে তাকে আঘাত করা হয়। এক পর্যায়ে তিনি লুটিয়ে পড়লে সহশিল্পীরা তাকে উঠিয়ে নিয়ে বের হয়ে যান। হামলার বিষয়ে রোকেয়া প্রাচী বলেন, "সন্ধ্যা সোয়া ৭টার দিকে আমাদের ওপরে অতর্কিত হামলা হয়। আমরা শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি পালন করছিলাম। হঠাৎ আমাদের ঘিরে ধরে বেধড়ক পেটানো হয়।"
গুরুতর আহত হওয়ার অভিযোগ করে তিনি বলেন, "যারা পিটিয়েছে তারা আমাকে টার্গেট করে এসেছে। প্রত্যেককে আমার শিক্ষিত মনে হয়েছে। তারা খুব শুদ্ধ ভাষায় কথা বলেছে। তাদের কথাবার্তা শুনেই বুঝেছি তারা দুষ্কৃতকারী নন।" এর আগে বুধবার (১৪ আগস্ট) সন্ধ্যায় তারা মোমবাতি প্রজ্বালন এবং এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে রোকেয়া প্রাচী বলেন, "আজ আমরা সবাই এখানে একত্রিত হয়েছি, কারণ বাংলাদেশ পুড়েছে। আমরা সবাই একত্রিত হয়েছি, কারণ আমাদের ১৯৭১ পুড়েছে। আমরা এখানে একত্রিত হয়েছি, কারণ আমাদের বঙ্গবন্ধুর ছবি পুড়েছে। ধানমন্ডির ৩২ পুড়েছে। আমরা এখানে একত্রিত হয়েছি বাংলাদেশ পুড়েছে বলে। আমরা এখানে কোনও রাজনীতির কথা বলতে আসিনি। বাংলাদেশ আমাদের সবার।''
তিনি বলেন, "আমরা এখানে শোক প্রকাশ করতে এসেছি শান্তিপূর্ণভাবে। আমরা বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা করি। তিনি আমাদের জন্য এই বাংলাদেশ দিয়েছেন, সংবিধান দিয়েছেন। এই ৩২ যখন পুড়েছে, তখন আমাদের মনে হয়েছে আমরা পুড়েছি। আমরা ধানমন্ডি ৩২-এ দাঁড়িয়ে সারা বিশ্বের এই মহানায়কের কাছে ক্ষমা চাইছি, আমরা লজ্জিত, বাঙালি জাতি আজ লজ্জিত।" রোকেয়া প্রাচী ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ জাতীয় চলচ্চিত্রের সেরা পার্শ্ব অভিনেত্রী পুরষ্কার পান। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আইন ও বিচার বিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলের দ্বিতীয় স্ত্রী ছিলেন রোকেয়া প্রাচী। তার বাবা আব্দুর রাজ্জাক ছিলেন বঙ্গবন্ধুর আমলে মিরপুর ও পল্লবী শ্রমিক লীগের সভাপতি।
দেশকণ্ঠ//আসো