দেশকন্ঠ অনলাইন : দারিদ্রতা আর নারীর প্রতি অবহেলার কারণে বাল্য বিয়ের শিকার হচ্ছে ভোলার চরাঞ্চলের মেয়েরা।এ উপকূলের অধিকাংশ পরিবারে অভাব-অনটন লেগেই থাকে। আর্থিক টানাপোড়েনের শিকার এসব দরিদ্র পরিবারের মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে দেয়া যেনো নিয়মে পরিণত হয়েছে।
কন্যা সন্তানকে বোঝা হিসেবে দেখেন তারা। তাই এ বোঝা যত দ্রুত বিদায় করা যায় ততোই ভালো, এমন প্রথায় বিশ্বাস করেন তারা। এলাকায় মেয়েদের সাধারণ ১০ থেকে ১৫ বছর বয়সের মধ্যেই বিয়ে দেয়া হয়। এর মাধ্যমে অনেকটাই দায়মুক্ত হতে চান বাবা-মা। ফলে অপরিণত বয়সের এ বিয়ের কারণে চরম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ভোগেন এ অঞ্চলের নারীরা।
বিশেষ করে অল্প বয়সে বিয়ে ও গর্ভধারণের কারণে নারীরা মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছেন। মায়ের কারণে অপুষ্ট ও বিকলাঙ্গতাসহ নানা সমস্যায় ভুগতে হচ্ছে চরাঞ্চলে জন্ম নেয়া শিশুদের। এমনকি,বাল্যবিয়ের কারণে বিচ্ছেদ এবং মৃত্যুও এখন হরহামেশাই ঘটছে এখানকার চরাঞ্চলে। সংসারেও দেখা দিচ্ছে নানান সমস্যা। সরেজমিন ভোলা সদরের মেঘনা মধ্যবর্তী বিচ্ছিন্ন মাঝের চর এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সেখানকার দরিদ্র পরিবারগুলোতে বাল্য বিয়ের নানা চিত্র। সেখানে গিয়ে কথা হয় মৎস্যজীবী নজির আলীর সঙ্গে তিন কন্যা আর এক পুত্র সন্তানের জনক তিনি। বড় মেয়ে খাদিজার বয়স ১৭ বছর। অভাবের সংসারে টানপোড়েন'র ছুতোধরে মেয়ে খাদিজাকে মাত্র ১৬ বছর বয়সেই বিয়ে দিয়েছেন।
মেয়েকে বাল্য বিয়ে কেনো দিলেন জানতে চাইলে বাবা নজির বলেন, "মায়া আমার ডাঙ্গর অইছে,বিয়াল্যাক অইছে,হেইকারনে বিয়া দিছি, এইডাতো দোষের কিছু না। একই চরে বসবাস সবুজ মাঝির। নদীতে মাছধরে আর জমিতে চাষাবাদ করে জীবিকা চলে তার। এক মেয়ে দুই পুত্র সন্তানের জনক তিনি।
সন্তানদের মধ্যে ১৫ বছর বয়সী কিশোরী আছমা-ই বড়। এ বয়সেই কিশোরী আছমাকে বিয়ে দিয়েছেন সবুজ মাঝি। এব্যাপারে কথা হয় কিশোরী আছমা'র মা নাজিয়া বেগমের সঙ্গে তিনি বলেন, মাইয়া বড় অইলেতো ঘরে আটকায়া রাহন উচিত না। তাছাড়া এহনই যদি বিয়া না দেই তাইলে মাইনসে কি কইবো,এইডাতো সরমের কতা। হেই কারনে বালা এওগ্যা পোলাল্যগে মায়াডারে বিয়া দিয়া দিছি। একই দুর্গম চরের অপর বাসিন্দা আবুল কালাম মাঝির কিশোরী কন্যা নার্গিস বলেন,১৪ বছর বয়সেই তার বিয়ে হয়েছে। এখন তার বয়স ষোলো। অল্প বয়সে পুত্র সন্তানের মা তিনি।
আটমাস বয়সী শিশু জারিফ'র কাশি আর জ্বর প্রকট আকার ধারন করেছে। সপ্তাহে দু'একবার উত্তাল নদী পেরিয়ে সদর হাসপাতালে নিতে হয় শিশু জারিফ'কে। বাল্য বিয়ের পর সংসারের ঘানি টানতে গিয়ে নিজেও রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। স্বামীর রোজগারের অভাবে চিকিৎসা চলেনা তার। দিনদিন শরীর শুকিয়ে কঙ্কালষাড় হচ্ছেন। সেখানকার স্থানীয় পল্লী চিকিৎসক কালিমুল্লাহ বলেন,অপ্রাপ্ত বয়সে বাল্যবিয়ের ফলে মাঝের চরে মা ও সন্তান দু'জনেই শিশু। এমন বহু পরিবারেই শিশুর কোলে শিশু পালনের দৃশ্য অহরহ। এ চরজনপদে এমন অসংখ্য খাদিজা,আছমা আর কিশোরী নার্গিসদের জীবন কেটে যায় বাল্যবিয়ে নামক মহামারির নির্মম যাতাকলে। এ জনপদের প্রত্যন্তঞ্চলে বয়স ১৮ বছর হওয়ার আগেই খাদিজা,আছমা আর নার্গিসদের মতো বহু কিশোরীদের বিয়ের ঘটনা নিত্যদিনের।এতদাঞ্চলের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মানুষেরা অভাব ও নিরাপত্তাহীনতার কারনে বাল্যকালে মেয়ের বিয়ের প্রস্তাবকে অত্যন্ত সম্মান ও লাভজনক মনে করেন। অল্প খরচে মেয়ের বিয়ে দিতে পেরেও ভীষণ খুশি থাকে দরিদ্র পরিবারগুলো।
এমন বহু পরিবারের অভিবাবকদের সঙ্গে কথা বললে তারা বলেন, বাল্যবিয়ে নিষিদ্ধ এটা আমরা জানি। কিন্তু অসহায় আমরা। আমাদের মেয়েদের কোনো নিরাপত্তা নেই,তাদের ভালোর জন্য কেউ আসেনা।এ কারনে পরিবারগুলোকে তাদের কন্যাদের বাল্য বিয়ে দিতে হয়। তাছাড়া উপকূলের অধিকাংশ পরিবার মৎস্য কাজে নিয়োজিত থাকায় বছরের ছয় মাস অভাব-অনটন লেগেই থাকে।
এছাড়া জেলে পরিবারের সদস্যরা বছরের বাকি ছয় মাস বেকার সময় পার করেন। আর্থিক টানাপোড়েন,পারিবারিক অস্বচ্ছলতা ও অসচেতনতার শিকার হয়ে এসব দরিদ্র পরিবারের কন্যা শিশুদের অল্প বয়সে বিয়ে নিত্যঘটনা।
সরেজমিন তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে,ভোলার গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ দরিদ্র পরিবার কন্যা সন্তানকে পরিবারের বোঝা বলে মনে করে। তাদের ভরণ পোষণের বাড়তি চাপ থেকে বাঁচতে অনেকে কিশোরী বয়সে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে থাকে।
এছাড়া বয়স হলে মেয়ের বিয়ে হবে না, এমনকি যখন স্কুলে পড়ুয়া মেয়েরা রাস্তা ঘাটে চলা ফেরা করে, ইভটিজিংয়ের শিকার হয় তখন এ সমস্ত পরিবারগুলো সমাজের মিথ্যা কুৎসা রটানো কে এড়ানোর জন্য অল্প বয়সে মেয়ে সন্তানকে বিয়ে দেন।
ভোলায় বাল্য বিয়ের সঠিক কোন সংখ্যা বা জরিপ কোথাও নেই, তবে ভোলার পুলিশ প্রশাসন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, শিশু সাংবাদিক, এনসিটি এফ ভোলা জেলা, ইউনিসেফ ভোলা জেলার প্রতিনিধিরা ও স্থানীয় এনজিও কোষ্ট-ট্রাষ্ট এর কর্মীরা'সহ সমাজের সচেতন ব্যক্তিরা ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রায় ৪শ' থেকে সাড়ে ৪শ' টি বাল্য বিয়ে প্রতিরোধ করেছেন বলে গণমাধ্যমের কাছে দাবি করেছেন।
এ বিষয়ে ভোলার মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের গাইনি বিশেষজ্ঞ ডা.পারভীন বেগম বলেন, একজন পূর্ণবয়স্ক মায়ের চেয়ে অপরিণত বয়সে মা হওয়ায় প্রসবকালীন ঝুঁকি দ্বিগুণ থাকে। ১৮ বছরের কম বয়সে অন্তঃসত্ত্বা হলে গর্ভপাতসহ প্রসবকালীন মৃত্যুর ঝুঁকিও থাকে সবচেয়ে বেশি। তিনি বলেন, কম বয়সে গর্ভধারণ করায় প্রসূতির শরীর ভেঙে যায়। নিজেকে বোঝার মতো উপলদ্ধির আগেই মেয়েরা দুই থেকে তিন বাচ্চার মা হওয়ার ফলে তাদের মানসিক ও শারীরিক ক্ষতির মুখে পড়তে হয়। এ বিষয়ে ভোলার জেলা প্রশাসক মো.আজাদ জাহান বলেন,এজেলায় বাল্য বিয়ে একটি সামাজিক ব্যাধি হিসেবে দেখা দিয়েছে। তবে জেলাব্যাপী এটিকে প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে আনতে উপজেলা প্রশাসন ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনী গণসচেতনতা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। ভোলা জেলা বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ কমটির সভাপতি এ্যাডভোকেট সাহাদাত শাহীন জানান,এজেলায় বাল্যবিয়ে এখন অপ্রতিরোধ্য মহামারী আকার ধারন করেছে।
তিনি জানান,দেশে বাল্যবিয়ের তালিকায় ভোলা এখন দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। এখানে বাল্যবিয়ের সঙ্গে একশ্রেণীর অসাধু কাজীচক্র জড়িত। এরা ভূয়া জম্ম নিবন্ধন তৈরী করে অপ্রাপ্ত বয়সী কিশোরীদের বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটায় বলেও জানান তিনি। ভোলার মানবাধিকার কর্মী নুরুন্নাহার বেগম বলেন, বাল্যবিয়ে নিরোধ আইনের সর্বোত্তম ব্যবহার ও আমাদের সচেতনতাই পারে বাল্যবিয়ে হাত থেকে জেলাবাসীকে রক্ষা করতে।
দেশকন্ঠ/এআর