দেশকণ্ঠ প্রতিবেদন : ‘টেস্টি অ্যান্ড হেলদি প্রোটিন ফর অল’ প্রতিপাদ্য নিয়ে ওয়ার্ল্ড পোলট্রি সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ শাখা এবং বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের আয়োজনে ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সিটি বসুন্ধরায় শুরু হয়েছে তিনদিনব্যাপী ‘ইন্টারন্যাশনাল পোলট্রি শো।’ উদ্বোধন করেন মাননীয় কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, “বাংলাদেশে একটা ব্যাপার হচ্ছে, খাদ্যওয়ালারা কখনও লস করে না। যারা মুরগি উৎপাদন করে, বাচ্চা উৎপাদন করে, আর ভোক্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।” তিনি আরো বলেন, “আমি জানি না কীভাবে এটা সমাধান হবে।”
সব মানুষের জন্য প্রোটিন তথা পুষ্টিকর খাবার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সরকার চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন বলে জানান রাজ্জাক। তিনি বলেন, “২০১৮ এর নির্বাচনে আমরা খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের কথা দিয়েছিলাম। শস্যে আমরা তা অর্জন করেছি। এখন আমাদের চ্যালেঞ্জ হচ্ছে নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাবার নিশ্চিত করা। “অনেক চালনির্ভর দেশের চেয়ে আমরা বেশি চাল খাই, কিন্তু আমাদের প্রোটিন খাওয়ার হার কম। দুধ, ডিম, মাছ-মাংস, ফল-সবজি যেন মানুষ পায় আমরা এখন সেই চ্যালেঞ্জের সামনে আছি।” দেশের মানুষের প্রোটিনের সহজ উৎস ব্রয়লার মুরগির বাজারে অস্থিরতার প্রসঙ্গ তুলে কৃষিমন্ত্রী বলেন, এই বাজার কেন অস্থির তা বিশ্লেষণ করে খুঁজে বের করতে হবে।
“কৃষির সবকিছুই পারস্পরিক নির্ভরশীল। মুরগি-ডেইরি করতে ফসল লাগে। মুরগির খাবার ভুট্টা, সয়াবিন থেকে তৈরি হয়। এসবের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে অস্বাভাবিক। দীর্ঘদিন খামারিরা লস করেছে, অনেক খামার বন্ধ হয়ে গেছে, নতুন বাচ্চা তুলেনি, যার কারণে উৎপাদন ও সরবরাহ অনেক কমেছে। এ কারণে বাজার অনেক চড়া, মানুষ কিনতে পারছে না।” আবার যখন উৎপাদন বেশি ছিল, তখনও মানুষ ক্রয় ক্ষমতা হারার কারণে কিনতে পারেনি উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এই কারণে খামারি ও কোম্পানিগুলোকে লস দিয়েছে। আবার আমাদের এত বড় পোলট্রি খাতের জন্য খাবার হিসেবে ট্যানারির বর্জ্য সরবরাহ করা হয়- এ কথার কোনো ভিত্তি নেই, অথচ এই তথ্য ব্যাপকহারে ছড়িয়ে এই খাতের ক্ষতি করা হয়েছে।”
সমাধানের পথ এখনও খুঁজে না পেলেও রোজায় পোলট্রি পণ্যের দাম না বাড়ার আশা করছেন রাজ্জাক। তিনি বলেন, “এই সময়ে চাহিদা কমে যায়, এর দাম বাড়বে না। সমস্যা হচ্ছে এখনই অনেক বেড়ে আছে। বাজার যেহেতু ভালো, তাই এখন অনেকেই নতুন করে বাচ্চা উৎপাদন করবে। পোল্ট্রি সবার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, তাই আমরা সজাগ থাকব যে, এর দাম মানুষের ক্ষমতার মধ্যে থাকে। “অস্বাভাবিকভাবে অনেক সময় বাচ্চা ও খাদ্যের দাম বাড়ায়। একটা বাচ্চা করতে ৩০-৩৫ টাকা লাগে, এটা কেন ৬০ টাকা হবে না। কোনোক্রমেই যেন এটা ৪৫ টাকার উপরে না যায়। এটা দেখার জন্য সরকারের তরফ থেকে একটা রেগুলেটরি বডি থাকতে হবে।” এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পোল্ট্রিতে দাম বাড়ায় ভোক্তা ও উৎপাদনকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ফিড প্রস্তুতকারীরা বরাবরই লাভ করে।
উদ্বোধনী পর্বে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরনারি সায়েন্স অনুষদের ডিন প্যাথলজি বিভাগের অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। তিনি তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে আমিষের চাহিদা মেটানোর জন্য পোলট্রির সম্ভাবনা ও প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। ওয়ার্ল্ড পোল্ট্রি সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ শাখার সাধারণ সম্পাদক মাহবুব হাসান বলেন, “ব্রয়লারের মাংসের গুণমান নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানো হয়। অনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে নানা গবেষণার নাম দিয়ে বাংলাদেশের ব্রয়লার নিয়ে মিথ্যা তথ্য প্রচার করা হয়।” এই খাতে সঠিক গবেষণার জন্য এবার থেকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০ জন স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীকে অনুদান দেওয়া হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, “২০২৫ সাল নাগাদ এই শিল্পকে আমরা রপ্তানিমুখী রূপ দিতে চাই।”
ওয়ার্ল্ড পোল্ট্রি সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ শাখার সহ-সভাপতি শামসুল আরেফিন খালেদ পোল্ট্রি খাতে চলমান সংকট নিরসনে সরকারের সহায়তা চান। এই সংগঠনের সভাপতি মশিউর রহমান বলেন, “যে দাম বেড়েছে সেটা অযৌক্তিক নয়। এটি মূলত প্রাইস কারেকশন। কম দামের পর কিছুদিন আগে আমাদের অনেক খামারি শেড বন্ধ করে ফেলেছিল। এই প্রাইস কারেকশনের পর তারা তৈরি হচ্ছেন, আমার সাথে কথা হয়েছে, তারা এই খাতে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।”
মৎস ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব নাহিদ রশিদ বলেন, “দেশের পোলট্রি খাত এখন অনেক সুসংগঠিত। এই খাতে অনেকের কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। কিছুদিনের মধ্যেই তৈরি পোশাক খাতের পর এটি দ্বিতীয় বৃহত্তম কর্মসংস্থান তৈরি করা খাতে পরিণত হবে।”
দ্বাদশ পোলট্রি শোতে দেশ ও দেশের বাইরের ৫৯১টি প্রতিষ্ঠান স্টল দিয়ে তাদের পণ্য প্রদর্শন করছে। পোলট্রি খাতে মাছ, মুরগি ও গবাদিপশু পালনে প্রয়োজনীয় সব পণ্যের সমারোহে সেজেছে এই পোলট্রি শো। পোলট্রি খাতে নতুন নতুন সব উদ্ভাবন ঠাঁই পেয়েছে এই মেলায়। মাছ-মুরগির ফিড, ওষুধ, শেড তৈরির সরঞ্জাম থেকে শুরু করে গরু-ছাগল মোটাতাজাকরণের পণ্য, বিভিন্ন জেনেটিক বুস্টার, আধুনিক স্মার্ট ওয়েট মেশিন, ফিড মিলের যন্ত্রপাতি, হ্যাচারির যন্ত্রাংশসহ নানা পণ্যের প্রদর্শন আকৃষ্ট করেছে খাতসংশ্লিষ্টদের।
শ্রীমঙ্গল থেকে আসা পোলট্রি খামারি হাসান মাহমুদ বলেন, “সবাই গতানুগতিকভাবে খামার করে। এখানে এসে বুঝা গেলো কতকিছু আবিষ্কার হয়ে গেছে। খুবই ভাল লাগছে। এখান থেকে কিছু শিখে গিয়ে নিজের খামারে কাজে লাগানোর চেষ্টা করব।” স্টল দেওয়া বিভিন্ন কোম্পানির প্রতিনিধিরা জানান, করোনা মহামারীর পর ক্রেতাদের সাথে সামনাসামনি যোগাযোগের এই সুযোগ পোলট্রি খাতকে সমৃদ্ধ করবে।
দেশকণ্ঠ/রাসু