দেশকন্ঠ অনলাইন : এমন একটা সময় ছিল, যখন সদ্যভূমিষ্ঠ শিশুর মুখে মধু কিংবা পানি তুলে দিতে নানি-দাদিদের আগ্রহের কমতি ছিল না। তাই কেউ রুপার বাটি-চামচ, কেউ-বা সোনার বাটি-চামচ নিয়ে হাজির হয়ে যেতেন সদ্যোজাত শিশুর সন্নিকটে। বর্তমান সময়ে সচেতন নানি-দাদিদের প্রথম অগ্রাধিকার হলো মায়ের বুকের প্রথম দুধ বা শালদুধ। কারণ, এখন তাঁরা জানেন, সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুর জন্য আদর্শ খাদ্য কখনোই মধু বা পানি হতে পারে না, বরং এই জাতীয় খাদ্য শিশুর জন্য ক্ষতিকর।
মায়ের দুধ শিশুর জন্য আদর্শ পুষ্টি সরবরাহ করে। কেননা এতে ভিটামিন, মিনারেল, প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, পানি ও ফ্যাট প্রায় নিখুঁত পরিমাণে থাকে, যা শিশুর সঠিক বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন।
পৃথিবীজুড়ে যত খাদ্য উপাদান আছে, তার মধ্যে এমন একটি উপাদান আছে, যা শিশুর সব পুষ্টি উপাদানে ভরপুর। সেটা হলো সুপার ফুড। এই সুপার ফুড হলো—মাতৃদুগ্ধ। মাতৃদুগ্ধ শিশুর রোগ প্রতিরোধে প্রথম টিকা বা ভ্যাক্সিন।
সন্তান জন্মদানের পর মায়ের বুকের ‘প্রথম দুধ’ শিশুর জন্য আদর্শ একটি খাবার। যাকে কোলেস্ট্রাম বলে। এর স্থায়িত্বকাল চার দিন। ঘন হলুদাভ এই কোলেস্ট্রাম নবজাতকের পরিপাকতন্ত্রের বিকাশে সাহায্য করে এবং মায়ের দুধ হজম করার জন্য শিশুর হজম প্রক্রিয়াকে প্রস্তুত করে। এই কোলেস্ট্রাম হলো মায়ের দুধের প্রথম ধাপ, যা পরে শিশুর বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তার প্রয়োজনীয় পুষ্টি প্রদান করে।
কোলেস্ট্রামের পর সামান্য কম ঘনত্বের যে দুধ আসে, সেটি হলো ট্রানজিশনাল মিল্ক, যার স্থায়িত্বকাল চার থেকে দশ দিন। শিশুর জন্মের দশ থেকে পনেরো দিনের মধ্যে তৃতীয় পর্যায়ে মায়ের বুকে পরিপক্ব দুধ আসতে শুরু করে, যা শিশুর ছয় মাস বয়স পর্যন্ত সব ধরনের পুষ্টি উপাদান সরবরাহ করতে সক্ষম হয়।
বেশির ভাগ শিশু জন্মাবার পর প্রথম ৩-৫ দিনের মধ্যে অল্প পরিমাণে ওজন হারায়, যা মায়ের দুধ খাওয়ানো বা কম খাওয়ানোর সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। আর সে জন্যই বিশ্বব্যাপী বিশেষজ্ঞরা শিশু জন্মানোর পর থেকে ছয় মাস বয়স পর্যন্ত এক ফোঁটা পানিও না খাইয়ে শিশুকে শুধু মায়ের বুকের দুধপানের জন্য উদ্বুদ্ধ করেন, যাকে এক্সক্লুসিভ ব্রেস্ট ফিডিং বলা হয়।
এক্সক্লুসিভ ব্রেস্ট ফিডিং শিশুর ডায়রিয়া, কানের সংক্রমণ, অ্যালার্জি ও অ্যাজমা হওয়ার ঝুঁকি কমিয়ে শিশুকে রাখে সুস্থ ও সবল। শুধু তাই নয়, জন্মের পর থেকে দুই বছর পর্যন্ত মাতৃদুগ্ধ পানে শিশু হয় বুদ্ধিসম্পন্ন, মেধাবী ও আত্মবিশ্বাসী। মাতৃদুগ্ধ পান শিশুর ওজন ঠিক রাখে এবং আকস্মিক শিশুমৃত্যুর হার কমায়।
মাতৃদুগ্ধ পানে শুধু যে শিশুটিই লাভবান হয়, তা কিন্তু নয়। এতে বেঁচে যান মা-ও। শুধু জন্মের পর থেকে দুই বছর পর্যন্ত মাতৃদুগ্ধ দানের মাধ্যমে একজন মায়ের স্তন ক্যানসার, ওভারিয়ান ক্যানসার, আর্থ্রাইটিস, ওভারিয়ান সিস্ট, ওস্টিওপোরোসিস, উচ্চ রক্তচাপ, কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ, ডায়াবেটিস প্রভৃতি রোগ হওয়ার ঝুঁকি কমে।
প্রসবজনিত ফিস্টুলার কারণ কী? জটিলতা দূর করার উপায় কী?প্রসবজনিত ফিস্টুলার কারণ কী? জটিলতা দূর করার উপায় কী?
শিশুকে মাতৃদুগ্ধ দানের ফলে মায়ের শরীরে অক্সিটোসিন ও প্রোল্যাকটিন হরমোন তৈরি হয়, যা মায়ের মানসিক চাপ কমাতে সহায়তা করে। মাতৃদুগ্ধ দান প্রসব-পরবর্তী সময়ে মায়ের অতিরিক্ত ব্লিডিং কমাতে ও জরায়ু দ্রুত আগের অবস্থানে ফিরে আসতে সহায়তা করে। এ ছাড়া মা ও শিশুর মধ্যে শারীরিক-মানসিক বন্ধন তৈরিতে সহায়তা করে।
লেখক: ক্লিনিক্যাল ডায়েটিশিয়ান, ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতাল, ঢাকা
দেশকন্ঠ//