দেশকণ্ঠ ডেস্ক, নিউইয়র্ক : বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়ম-নীতি এবং রাষ্ট্রদূতের আচরণ বিধি লঙ্ঘন করে মেক্সিকোতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মুশফিকুল ফজল আনসারী নিউইয়র্কস্থ বাংলাদেশ কনসাল জেনারেলের কার্যালয়ে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করেছেন। অভিযোগ রয়েছে সরকারি নিয়ম-নীতির উপেক্ষা করে উক্ত সভার আয়োজন করেন খোদ কনসাল জেনারেল নাজমুল হুদা। তিনি তার কর্মচারীদের দ্বারা যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির নেতাকর্মীদের ফোনে করে ও ক্ষুদে বার্তার মাধ্যমে উক্ত মতবিনিময় সভার আমন্ত্রণপত্র পাঠান।
রাষ্ট্রদূত মুশফিকুল ফজল আনসারী যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কস্থ বাংলাদেশ কনসাল জেনারেলের কার্যালয় পরিদর্শনের জন্য প্রস্তাব দেন। তার এ সফরের জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোন অনুমতি ছিল না বলে জানা গেছে। তার এ প্রস্তাব পেয়ে কনসাল জেনারেল একটি আমন্ত্রণপত্র তৈরি করেন। সেখানে উল্লেখ করেন
প্রিয় সুধী, আসসালামু আলাইকুম,
মেক্সিকোতে নিযুক্ত বাংলাদেশের মান্যবর রাষ্ট্রদূত জনাব মুশফিকুল ফজল আনসারী আগামীকাল (০৪ এপ্রিল, ২০২৫) শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে পাঁচ ঘটিকায় বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেল, নিউইয়র্ক-এ শুভেচ্ছা সফর করবেন। মান্যবর রাষ্ট্রদূত উক্ত সময়ে বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেলে আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আগ্রহী। এ প্রেক্ষিতে আগামীকাল সন্ধ্যা ০৫.৩০ ঘটিকায় বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেল, নিউইর্য়ক এ আপনি সাদরে আমন্ত্রিত।
ধন্যবাদান্তে,
বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেল, নিউইর্য়ক
(মান্যবর রাষ্ট্রদূত জনাব মুশফিকুল ফজল আনসারী’র পক্ষে )
রাষ্ট্রদূত মুশফিকুল ফজল আনসারী নিজেও বেশ কিছু ধানের শীষ মার্কা সাংবাদিক ও বিএনপির নেতাকর্মীদের ফোন করে সেখানে উপস্থিত থাকার আমন্ত্রণ জানান। উক্ত মতবিনিময় সভায় উপস্থিত প্রায় সকলেই বিএনপির নেতাকর্মী বলে জানা গেছে।
বিভিন্ন কূটনীতিক সূত্রে জানা গেছে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস কিংবা সরকারি দপ্তরগুলো মেক্সিকোর বাংলাদেশ রাষ্ট্রদূতের অধিক্ষেত্র বা এখতিয়ারে নেই। তাই মেক্সিকো বা অন্য কোন দেশের বাংলাদেশ রাষ্ট্রদূ্তরা যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য দেশের কোন দরকারি দপ্তর পরিদর্শন করতে হলে কূটনীতিক নিয়মানুসারে অবশ্যই সরকারি অনুমতিপত্র লাগবে। পরিদর্শনের পুর্বেই সংশ্লিষ্ট কমকর্তাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক অবশ্যই চিঠি দিয়ে পুর্বেই অবহিত করবেন। কিন্তু এসব নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই মুশফিকুল ফজল আনসারী ব্যক্তিগত প্রভাব খাঁটিয়ে নিউইয়র্কস্থ বাংলাদেশ কনসাল জেনারেলকে ব্যবহার করে সরকারি অফিসে বসেই দলীয় সভা বা বিএনপির নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করেন। যদিও বিএনপি এখনও কোন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় নেই। এ নিয়ে নিউ ইয়র্ক প্রবাসী বাংলাদেশিদের মাঝে নানা গুঞ্জণ শুরু হয়েছে। প্রবাসীদের অনেকেই বলেছেন সার্বজনীন মতবিনিময় সভা হলে নিউইয়র্কস্থ বাংলাদেশ কনসাল জেনারেল সকল শ্রেণী পেশার মানুষকে আমন্ত্রণ জানাতেন। বেছে বেছে বিএনপির নেতাকর্মীদের আমন্ত্রণ দেওয়া হতো না।
যুক্তরাষ্ট্র বিএনপি নেতা জিল্লুর রহমান জিল্লু বলেন, তিনি কলস্যুলেট ভিজিট করতে এসেছিলেন।সেখানে কনস্যুলেট তার সম্মানে কম্যুনিটির নেতৃবৃন্দকে বিশেষ করে যারা ফ্যাসিস্ট বিরোধী এই প্রবাসে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাদেরকে দাওয়াত দেয়া হয়। সেখানে গোলটেবিল মতবিনিময় হয়। বিএনপি ছাড়াও বাইরের অনেকেই ছিলেন। এটা কোন বিএনপির মিটিং ছিলো না।
বিএনপি নেতা আকতার হোসেন বাদল বলেন, সরকারি কোনো স্থানে রাজনৈতিক কার্যকলাপ থাকা উচিত নয়, যদি না কোনো সরকারি প্রতিনিধি দেশের সংকট বা অন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনার জন্য সব রাজনৈতিক দলকে আমন্ত্রণ জানান। আমি বিশ্বাস করি, এই মুহূর্তে আমাদের একসাথে কাজ করা উচিত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও গণতন্ত্রকে দৃঢ় করার জন্য। পাশাপাশি আমরা একটি অবাধ ও সুষ্ঠ নির্বাচন প্রত্যাশা করি। বিএনপি নেতা মাকসুদুল এইচ চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশ কনস্যুলেটের আয়োজনে উক্ত অনুষ্ঠানের প্রবাসের অনেক মানুষ ছিল। প্রবাসীদের পাশাপাশি বিএনপির কিছু নেতা কর্মী যারা দীর্ঘ ১৭ বছরের ফ্যসিস্টের বিরুদ্ধে সংগ্রামে মুশফিকুর ফজল আনসারীকে সাথে কাজ করেছেন, স্বাভাবিকভাবে ওনার সাথে মত বিনিময় কিংবা আড্ডাতে বিএনপি নেতা কর্মী থাকলে দোষের কিছু আছে বলে আমি মনে করিনা। তাছাড়া ওখানে কোন ফর্মাল মিটিং হয়নি। জাস্ট আড্ডার মতো আলোচনা হয়েছে। বিএনপি নেতা কর্মীরাওতো বাংলাদেশী বংশোদ্ভুত, অতএব বাংলাদেশের একজন রাষ্ট্রদুতের সাথে বাংলাদেশিরা আড্ডা দিলে কিংবা কোন আলোচনা করলে অন্যায় কিছু হয়েছে বলে আমি মনে করিনা। ওখানে আরো উপস্থিত ছিলেন কুইন্স কোর্টের বিচারক সোমা সাঈদ, ডেমোক্র্যাট ডিস্ট্রিক্ট লিডার এটর্নী মঈন চৌধুরী, আইটি বিশেষজ্ঞ মিজানুর চৌধুরী, অনলাইন একটিভিষ্ট মাসুমসহ অনেকেই।
বিএনপি নেতা মোতাহার হোসেন বলেন, আমি বিভিন্ন মাধ্যমে দাওয়াত পেয়ে রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে সেখানে গিয়েছি। সেখানে আমার মতো বিএনপির অনেক নেতাকর্মীরাই উপস্থিত ছিলেন। নিউইয়র্কের কমিউনিটি এক্টিভিষ্ট নাসির খান পল বলেন, রাষ্ট্রের কোন অফিসে কোন রিশেষ দলের সভা একেবারে নিষিদ্ধ এবং বেআইনি। আমরা কনসাল জেনারেলকে এই ব্যাপারে অবশ্যই জবাবদিহিতার আওতায় আনতে পারি। উনি তার কার্যালয়ে এ ধরনের রাজনীতিকরণ করার কোন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকতে পারেন না। জীবনে প্রথম দেখলাম একজন ভ্রাম্যমান সাংবাদিক কিছু প্রশ্ন করার সুযোগ পেয়ে রাষ্ট্রদূত পদ উপহার পান।
কমিউনিটি এক্টিভিষ্ট আল আমিন রাসেল বলেন, আন্দোলনোর পর আমার আজকে সবচাইতে মন খারাপ হইছে বাংলাদেশে কনস্যুলেটের চিত্র দেখে। রীতিমতো আওয়ামীলীগ যা করতো সবই করতেছে বিনপি। সামনে বসা নিয়ে নিজেদের মধ্যে তর্ক। বিনপির লোক ছাড়া কেও নাই। কনস্যুলেটকে মনে হইলো তাদের দলীয় আড্ডার জায়গা। কনস্যুলেট কর্মকর্তাদের দেখেও মনে হইলো তারা খুব অসহায়। অথচ ৫ অগাস্টের পর এইসব জায়গা হওয়ার কথা ছিল শুধু জনগণের কোনো দলের না। ছবিটা দেখেন শুধু যুক্তরাষ্ট্র বিনপির সভাপতি রাষ্ট্রদূতদের কাঁধের উপরে কেমনে হাত দিয়ে দাঁড়াইছে। তারা বন্ধু হইতে পারে কিন্তু রাষ্ট্রদূত একটা দেশের প্রতিনিধি। নূন্যতম শিষ্টাচারটুকু নাই তাদের।
মেক্সিকো থেকে এসে নিউইয়র্কস্থ বাংলাদেশ কনসাল জেনারেলের কার্যালয়ে কীভাবে একটি দলীয় মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হলো এ প্রশ্নের উত্তরের জন্য কনসাল জেনারেল নাজমুল হুদার সঙ্গে ফোনে ও ক্ষুদে বার্তায় যোগাযোগ করা হয়। তিনি ফোন না ধরলেও ক্ষুদে বার্তায় তার মতামত দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তিনি লিখেন ‘নো কমেন্টস।
এ ব্যাপারে রাষ্ট্রদূত মুশফিকুল ফজল আনসারীকে মুঠোফোনের ক্ষুদে বার্তায় প্রশ্ন করা হয়েছিলে যে নিউইয়র্ক বাংলাদেশ কন্স্যুলেট কার্যালয়ে শুক্রবার রাতে আপনি বিএনপি নেতাকর্মীদের সঙ্গে একটি মতবিনিময় সভা করেছেন সেখানে মেক্সিকোর বাংলাদেশ রাষ্ট্রদূত হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির নেতাকর্মীদের সামনে বক্তব্য দিয়েছেন। কেন এবং কি কারণে কন্স্যুলেটে বসে বিএনপির নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করলেন জানাবেন। আপনার মতামত জরুরি। এ প্রশ্নের জবাবে তিনি উত্তর দেন ‘আই লেট হিম ডাই।’ বুঝতে না পারায় বিষয়টি পরিস্কার করার জন্য অনুরোধ করা হলে তিনি লিখেন- ‘আমি এখন কাজে আছি, এখন নিউইয়র্কে নাই’ আমি কম্বোডিয়ায়। তিনি শেষে গুডবাই বলেন।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতদের জন্য প্রযোজ্য চাকরির নিয়মাবলী প্রধানত বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) পররাষ্ট্র ক্যাডার ও সংশ্লিষ্ট বিধিমালার আওতায় পরিচালিত হয়, যার মধ্যে নিয়োগ, পদোন্নতি ও আচরণবিধি অন্তর্ভুক্ত। রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করেন রাষ্ট্রপতি বা তাঁর কর্তৃক নির্ধারিত কোনো কর্মকর্তার মাধ্যমে। বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) পররাষ্ট্র ক্যাডার ও সংশ্লিষ্ট বিধিমালা বহির্ভুতভাবে বিশেষ বিবেচনায় ২০২৫ সালের ২৭ জানুয়ারিতে তাকে মেক্সিকোর বাংলাদেশ রাষ্ট্রদূতের পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু ব্যক্তিগত প্রভাব খাটিয়ে তিনি রাষ্ট্রদূতের আচরণ বিধি লঙ্ঘন করেছেন বলে অনেকেই ধারণা করছেন। রাষ্ট্রদূত মুশফিকুল ফজল (আনসারী) কোন কূটনীতিক নন। তিনি একজন সাংবাদিক ছিলেন। অথচ তিনি নিজের প্রফাইলে নিজেকেই একজন খ্যাতিমান কূটনীতিক হিসেবে উল্লেখ করেছেন। শুধু তাই নয় তিনি নিজেকে একজন জনসেবকও বলেছেন।