মেজর (অব.) চাকলাদার : হকি এক ছন্দের খেলা। ড্রিবলিং করে গতিতে এগিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে দর্শক যে আনন্দ পায়; তা বহুদিন তাদের স্মৃতিতে উজ্জ্বল থাকে।
১৯৮২ সালে করাচিতে খেলার সময় বাম পায়ে প্রচণ্ড ব্যথা পাই। টিমের মাথা ছিলেন সাদেক ভাই। তাকে বললাম আগামী খেলা খেলতে পারবো না। সাদেক ভাই বললেন খেলতে হবে; কেনো? জানালাম- ব্যথা পেয়েছি; হাঁটতেই তো পারছি না। একস্ট্রা থেকে এক জনকে নামান। সাদেক ভাই বললেন না; তুমিই খেলবে। সাদেক ভাইর মুখের উপর কথা বলার সাহস কোন দিনও ছিলনা। রুমে চলে আসলাম। একটু পর দেখি বালতি ভরা বরফ দিয়ে একস্ট্রা এক খেলোয়াড় পাঠিয়েছেন, সে সারা রাত বাম পায়ের হাঁটুতে বরফ চেপে রাখল। খেলার জন্য মাঠে গেলাম। সাদেক ভাই বললেন, তোমার দৌড়াতে কষ্ট তবে তোমার উপর আমার কনফিডেন্স আছে, তুমি ওয়ান টাচে খেলবে। বল পেয়ে ‘হ্যান্গ’ না করে সাথে সাথেই বল দিয়ে দিবে। তাই করলাম। বেশ কিছু ‘স্কুপ’ করলাম (ফুটবলে যেটা ‘লব’ হকিতে সেটাই ‘স্কুপ’)। ভালই খেললাম। করাচি থেকে ঢাকায়। পায়ে ব্যথা। রুমেই শুয়ে রইলাম। আমি তখন ফার্স্ট বেংগল বা সিনিয়র টাইগারর্স-এ। দুর্দান্ত আর শ্রেষ্ঠ এক ব্যাটেলিয়ন। আমার ব্যাটেলিয়ন তখন বান্দরবনে। আমাকে বলা হল করাচিতে প্রতিটি খেলা খেলেছ আর এখানে রুমে শুয়ে থাকবে তা হবে না। কর্নেল ফেরদৌস আমার সিনিয়র। নিজেও জাতীয় হকি দলের গোলরক্ষক। স্যার বললেন, তুমি সিএমএইচ যাও। দলে আমার কোর্সমেট মোসাদ্দেক আছে; চলো সিএমএইচ যাই। গেলাম। এক্সরে হলো। পরদিন গেলাম রিপোর্ট আনতে। নার্সিং এ্যসিস্ট্যান্ট আমাকে এক্সরে রিপোর্টটা দিল। লেখা আছে লেফট নি লোয়ার প্যাটেলা ফ্রাকচার। বললাম, এই আমার রিপোর্টটা দাও, এটারতো লেফট নি ফ্রাকচার রিপোর্ট আছে। নার্সিং এ্যাসিস্ট্যান্ট বলল, স্যার আপনি ক্যাপ্টেন চাকলাদার না? আমি বললাম; হ্যা। বলল, আপনার নি ফ্রাকচার হয়েছে। দাঁড়িয়ে ছিলাম, থতমত অবস্থা, চার পাঁচ কদম দূরে চেয়ার, যেতে চাইলাম। পারলাম না। মোসাদ্দেককে বললাম, আমাকে ধর। এর নামই শক এফেক্ট। করাচিতে আন্তর্জাতিক সবগুলো ম্যাচ খেলেছি। সকালেও মাঠে প্রাকটিস করেছি আর এখন! পা প্লাস্টার করে সিএম এইচে এ্যাডমিট করে দিল।
আব্দুস সাদেক ভাই এক বোতল হরলিকস নিয়ে দেখতে আসলেন, আর রুম হয়ে গেল ফলের দোকান। ভাল লাগল, যেই দেখতে আসে সেই আমার পায়ের প্লাস্টারে সিগনেচার করে যায়। সিগনেচারের আর যায়গা নাই, মোসাদ্দেক বলল, তোমার ডান পা প্লাস্টার করতে বলি। তা হলে বাকিরা ডান পায়ের প্লাস্টারের উপরও সিগনেচার দিতে পারবে। আলিউজ্জমান ভাই হকি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন, ইনসিওরেন্সের বড় কর্মকর্তাও ছিলেন। পা ইনশিওরেন্স করা ছিল। পা ফ্রাকচারের বদৌলতে প্রায় পঞ্চাশ হাজার টাকা পেলাম। আলিউজ্জমান ভাই সব বন্দোবস্ত করে দিয়ে ছিলেন।
মোসাদ্দেকের কথা বলছিলাম, ইতিহাসবিদ প্রফেসর কে আলির সন্তান। মোসাদ্দেক তখন লেফটানেন্ট কর্নেল। কয়েক বছর আগে এক বৃষ্টির রাতে বাসাতে আসা অতিথিকে মোটর সাইকেল করে জাহাঙ্গীর গেটের কাছে নামিয়ে ফিরতি পথে শাহীন সিনেমা হলের সামনে ডিভাইডারে মাথায় বারি খেয়ে ওখানেই স্পট ডেথ। এক দুর্দান্ত অফিসার আর বিশাল মনের মানুষ, আমার শ্রেষ্ঠ বন্ধুকে চিরতরে হারালাম—
‘তুমি যে গিয়াছো বকুল বিছানো পথে
দিয়ে গেছো মোরে শত পরাজয়
ফিরে এসো জয় রথে’
জয় রথে ফিরবে না, আমারাই স্মৃতি আঁকড়ে পরে থাকব।
পরিস্কার মনের মোসাদ্দেক নিশ্চয় বেহেস্তের দাবিদার ।
লেখক : সাবেক অধিনায়ক জাতীয় ও সেনাবাহিনী হকি দল এবং জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারপ্রাপ্ত
দেশকণ্ঠ/আসো