হেদায়েত মন্ডল : [বাঘ লোকালয়ের পাশের জঙ্গলে (বন) থাকে। লোকালয়ে মানুষ, পশু, প্রাণী সবাই ভয়ে থাকে কখন কি হয়। বাঘের সর্বনাশী স্বভাব চরিত্র সবাই অবগত।]
বাঘ সমাজের চাহিদা অনুযায়ী বাঘের স্কুলে শিশু বাঘদের যা শিখানো হয় তার সারমর্ম হলো- লোকালয়ে মানুষ থাকে তাদের দুটি পা মাটিতে থাকে আর দুটি পা থাকে উপরে, দেখতে লম্বা, উপরের পা দুটিতে লাঠি, বর্শা, দা, সরকি ইত্যাদি ধরে মুখে অদ্ভুত শব্দ করতে করতে এগিয়ে আসে। অসভ্যের মত বাঘদের আঘাত করে। মেরেও ফেলে। ওরা আমাদের অধিকার বোঝে না। ওরা কিন্তু আমাদের বনে এসে যা ইচ্ছে তাই করে, আমাদের বিপদে ঠেলে দিচ্ছে। ইত্যাদি ইত্যাদি।
একটি বাঘ শাবক লোকালয়ের দিকে তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করে যে, ঐ লোকালয়ের অদ্ভুত জীব কেমন? কৌতুহল দিনে দিনে বাড়তে থাকে কিন্তু বড়দের শাসন আর চোখ এড়িয়ে যেতে পারে না। একদিন সে সাহস করে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে লোকালয়ের দিকে গেল। অনেক ভয়ে ভয়ে এগিয়ে যেতে থাকলো। কখন যে লোকালয়ের ভিতরে প্রবেশ করেছে বুঝতেই পারে নি! হুই হুই করে কিছু লোক ছুটে তেরে আসলো তখন সে কোন দিকে দৌড় দিবে বুঝতে না পেরে এক জনের বাড়িতে ঢুকে পড়ে। বাড়ির লোকজন অস্থির , উদ্বিগ্ন, ভয়ে অবস্থা খারাপ। কেউ কেউ বাড়ি ছেড়ে দৌড় দিলেও একজন বৃদ্ধা দৌড় দিতে পারে নি। বাঘ শাবক ভীত সন্ত্রস্ত চোখে সে বৃদ্ধার দিকে তাকালো। বৃদ্ধাও তার দিকে তাকালো। বাঘ শাবক বুঝতে পারছেনা কি করা দরকার! বৃদ্ধা ভাবছে জীবনের শেষ সময়ে শেষ পর্যন্ত বাঘের হাতে মরতে হবে! যা থাকে কপালে। হাতের লাঠি মাটিতে ঠুকরে দিয়ে বাঘ শাবক কে বললো, যৌবনে তোমার মত অনেক বাঘের চোখে ধুলো দিয়েছি, দু এক ঘা দিয়েছি। তুমি সে সবের প্রতিশোধ নিও না। আর আমাকে মেরে ফেললে এখান থেকে তুমি জ্যান্ত ফিরতে পারবে না। .. বাঘ শাবক বৃদ্ধার কথা যাই বুঝুক সে বুঝলো যত শোরগোল আওয়াজ শোনা যাচ্ছে তাতে কোনদিকে না গিয়ে চুপচাপ এখানে থাকায় ভালো। ওরা যদি মারে মারুক। দুজনেই দুজনের জীবনের শেষ সময় ভাবছে, আর নিয়তির কাছে নিজেকে সমর্পন করছে।
গাই গুই করতে করতে বাঘ শাবক বৃদ্ধা থেকে তিন চার হাত দূরেই বসে পড়ে। তর্জন গর্জন না করে চুপচাপ বসে থাকে। খানিক পরে বৃদ্ধা প্রচলিত রীতি অনুসারে কিছু খাবার, কলা, ইত্যাদি বাঘের সমানে দিতে থাকে, এর কোনটা বাঘ খায়, কোনটা খায় না। এক পর্যায়ে বৃদ্ধা পানি দিলে বাঘ পানি পান করে। বেশ আরাম অনুভূত হলে আয়েসে শরীর নেতিয়ে দেয় যেন ঘুমাবে।
বৃদ্ধার মনে হল, মরবো যখন, তখন বাঘকে ছুঁয়ে দেখি। আস্তে আস্তে বাঘের কাছে চলে আসে, প্রথমে হাতের লাঠি দিয়ে আলতো ছুঁয়ে দেয়, বাঘ একটু নড়ে ওঠে কিন্তু চুপ। বৃদ্ধা এরকম বেশ কয়েক বার করলো। কিন্তু বাঘ যেন ঘুমিয়ে রইলো। বুড়ি যেন শেষ দম নিয়ে এবার হাত বাঘের গায়ে দিল, বুলিয়ে দিল শরীরের কিছুটা অংশ। বাঘের শরীর কেপে উঠলো। বুড়ি ভাবলো এবার তার ঘাড় মটকে দিবে। তবু থামে না সে ক্রমশঃ হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। এক পর্যায়ে বাঘ পিট পিট করে চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে বুড়ির দিকে। দ্রুত সে শোয়া থেকে উঠে বসে। মুখ দিয়ে শব্দ করে জিহ্বা দিয়ে বুড়ির হাত চেটে দেয়। এরকম বেশ কয়েক বার দুজনের মধ্যে চলতে থাকে। বুড়ি সাহস পেয়ে বলে, 'তুই পথ ভুলে এসেছিস মনে হচ্ছে। কিন্তু তোকে তো ওরা মেরে ফেলবে! তোর জন্য কি করতে পারি। তোর প্রতি মায়া হচ্ছে কেন?' বুড়ির কথার তালে তালে বাঘ মুখ দিয়ে শব্দ করে।
ওদিকে যারা বুড়ির আশা ছেড়ে দিয়ে অস্ত্র লাঠি নিয়ে রেডি ছিল বাঘকে মারার জন্য তারাও উৎসুক হয়ে দেখতে থাকে যে, বুড়ি তো বাঘের সাথে গল্প করছে! বুড়ির এ অবস্থা দেখে অনেকে আস্তে আস্তে বাঘের কাছে চলে আসে। বাঘ সবার সাথে বেশ খোশ মেজাজে থাকে। কেউ বলে মেরে ফেল, কেউ বলে না, কেউ বলে দাবড়ানি দিলেই পালিয়ে যাবে। এক পর্যায়ে সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেয় যে, এই বাঘ কারো কোন ক্ষতি করে নি, একে মারা অন্যায় হবে। আমরা অন্যায় করব না। লোকালয়ের সবাই মিলে বাঘকে নিয়ে বনের দিকে বাঘের বাড়ির দিকে যাত্রা করে। বাঘ বেশ হেলেদুলে হাঁটতে থাকে। দূর থেকে বাঘের পরিবারের লোকজন দেখে তাদের বাঘ বেশ গর্বের সাথে এগিয়ে আসছে; আর তার পিছনে দুপায়ের জীব বেশ আনন্দ ধ্বনি দিচ্ছে যা আগে কখনো শোনেনি!
দেশকণ্ঠ/আসো