• রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১  নিউইয়র্ক সময়: ০৩:১৯    ঢাকা সময়: ১৩:১৯

আদিবাসী নারী মুক্তিযোদ্ধা

মোঃ জোবায়ের আলী জুয়েল, দেশকন্ঠ  : একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসী নারী মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান ছোট করে দেখার মতো নয়। খাসিয়া নারী কাঁকন বিবি ও কাঁকেট, রাখাইন নারী প্রিনছা খে, গারো নারী সন্ধ্যারানী সাংমা, ভেরোনিকা সিমসাংসহ অনেক নারী মহান মুক্তিযুদ্ধে স্মরণীয় অবদান রেখেছেন। বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা কাঁকন বিবি সেক্টর কমান্ডার মীর শওকত আলী ও ক্যাপ্টেন হেলাল উদ্দিনের অধীনে পরিচালিত শহীদ কোম্পানির একজন সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। কাঁকেট মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে গোয়েন্দাগিরি করতে গিয়ে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। তিন মাস সেনাক্যাম্পে বন্দী অবস্থায় নির্যাতন-নিপীড়নের পর সেনাক্যাম্পেই তাঁর মৃত্যু ঘটে। প্রিনছা খে মূলত মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন ক্যাম্পে সেবিকার দায়িত্ব পালন করতেন। পাকিস্তানী বাহিনী প্রিনছা খেকে বন্দী করে। তার ওপর বর্বর নির্যাতন চালায় অহরহ। গোপনে বিষ সংগ্রহ করে   পাকিস্তানী সেনাদের খাবারে তা মিশিয়ে প্রিনছা খে ১৫ পাকিস্তানী সেনাকে মেরে ফেলেন। সারা বাংলাদেশে এমন অসংখ্য আদিবাসী নারী মুক্তিযুদ্ধে নিজেদের ইজ্জত বিকিয়েছেন। অস্ত্র ধরেছেন   পাকিস্তানী বর্বর পশুদের বিরুদ্ধে। ক্যাম্পে ক্যাম্পে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের স্বাস্থ্যসেবা দিয়েছেন। এমনই দু’জন নারী মুক্তিযোদ্ধা হলেন- সন্ধ্যারানী সাংমা ও ভেরোনিকা সিমসাং।

সন্ধ্যারানী সাংমা :
একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে যে ক’জন নারী বিশেষ অবদান রেখেছেন তাঁদের মধ্যে একজন হলেন সন্ধ্যারানী সাংমা। টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর জানজালিয়া গ্রামে তিনি ১৯৫৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা জমির মারাক। মাতার নাম রিংমি। বর্তমানে তিনি নেত্রকোনা জেলার কলমাকান্দা  উপজেলার নলচাপ্রা গ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। পিতা-মাতার একমাত্র সন্তান সন্ধ্যারানী সাংমার মধুপুর জলছত্র মিশন স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষায় হাতে খড়ি। অতঃপর ভূটিয়া হাইস্কুলে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। পিতা ছিলেন একজন কৃষক। মাতা আদিবাসী সমাজের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ঘরে ও কৃষিক্ষেতে কাজ করতেন। ১৯৬৯ সালে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটে জয় রামকুড়া খ্রীস্টান মিশনারি হাসপাতালে নার্সিং ট্রেনিং সেন্টারে ভর্তি হন।

১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন নার্সিং দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ময়মনসিংহ থেকে হালুয়াঘাটের দিকে অগ্রসর হলে সন্ধ্যারানী সাংমা তাঁর দূর সম্পর্কীয় বোন ভেরোনিকা সিমসাংয়ের সঙ্গে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের মহেন্দ্রগঞ্জ থানার অধীনে চাপাহাতি গ্রামে পৌঁছেন।

এ সংবাদ শুনে হালুয়াঘাটের জয় রামকুড়া নার্সিং হাসপাতালের ডাক্তার প্রেমাংকুর রায় সন্ধ্যারানী সাংমা ও ভেরোনিকা সিমসাংকে ১১ নং সেক্টরের অধীনে অবস্থিত ফিল্ড নার্সিং হাসপাতালে নিয়ে আসেন। যে হাসপাতালের দায়িত্বে ছিলেন ১১ নং সেক্টরের ক্যাপ্টেন আব্দুল মান্নান ও ডাক্তার প্রেমাংকুর রায়। হাসপাতালটির অবস্থান ছিল বাঘমারা ক্যাম্প থেকে ৪০০ গজ দূরে। সেই হাসপাতালে মেডিক্যাল ওয়ার্ড ও সার্জারি ওয়ার্ডে প্রতিদিন আহত ও রোগাক্রান্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা দেয়া হতো।

সন্ধ্যারানী সাংমা সেপ্টেম্বর মাসের দিকে ধানুয়া-কামালপুর হয়ে জামালপুরে প্রবেশ করেন। সেখানে একটি রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করেন এবং তাদেরকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করেন। শেরপুরে ২৯ দিন অবস্থান করে সন্ধ্যারানী সাংমা মুক্তিযোদ্ধাদেরকে চিকিৎসা সেবা দেন। এরপর বকশীগঞ্জ হয়ে জামালপুরে যান এবং দুটি অপারেশনে তিনি সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। দুই সপ্তাহ পর জামালপুর হানাদার মুক্ত হয়। জামালপুর হানাদার মুক্ত হলে দু’জন ভারতীয় সৈন্যের তত্ত্বাবধানে সন্ধ্যারানী সাংমা মধুপুরে নিজ বাড়িতে পৌঁছেন।

যুদ্ধকালীন প্রতিটিক্ষণ সন্ধ্যারানী সাংমার কাছে স্মরণীয়। একদিন বকশীগঞ্জের একটি মাঠে তাঁবু খাটিয়ে অস্থায়ী হাসপাতালে সন্ধ্যারানী সাংমা, ভেরোনিকা সিমসাং, দুলাল মিয়া, ডাক্তার প্রেমাংকুর রায়, ক্যাপ্টেন আব্দুল মান্নানসহ আট/দশ জনের একটি টিম কর্মরত ছিলেন। হঠাৎ তাঁবুর পার্শ্বে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিকট বোমার আওয়াজ পাওয়া যায়। তাঁবুর প্রায় কাছাকাছি বোমাটি ফাটে। অল্পের জন্য তাঁরা সকলে রক্ষা পান।

সন্ধ্যারানী সাংমা ১৯৭৩ সালের ১৬ জানুয়ারি নেত্রকোনা জেলার কলমাকান্দা উপজেলার নলচাপ্রা গ্রামের চার্চিল কুবীকে বিয়ে করেন। পারিবারিক জীবনে তিনি জেবিরাজ দোলন কুবী, অহিমাস সাংমা ও মঞ্জুশ্রী মৃ নামে দুই পুত্র ও এক কন্যা সন্তানের জননী। সন্ধ্যারানী সাংমা কলমাকান্দা এলাকায় একজন আদিবাসী নারীনেত্রী হিসেবে সুপরিচিত। ‘দৈনিক প্রথম আলো’, ‘দৈনিক সমকাল’সহ বিভিন্ন পত্রিকায় সন্ধ্যারানী সাংমাকে নিয়ে বিশেষ ফিচার প্রকাশ করেছে। সন্ধ্যারানী সাংমা মুক্তিযুদ্ধে গারো নারী হিসেবে ‘অনন্যাশীষ দশ-২০০৮’ পুরস্কার পান।

ভেরোনিকা সিমসাং :
ভেরোনিকা সিমসাং টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর উপজেলার আমলীতলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম বিশ্বনাথ চাম্বুগাং। মাতার নাম কামিনী সিমাসাং।

 ভেরোনিকা সিমসাং ১৯৬৯ সালে ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাটের জয় রামকুড়া খ্রীস্টান মিশনারি হাসপাতালে নার্সিং ট্রেনিং সেন্টারে ভর্তি হন। ১৯৭১ সালে তিনি নার্সিং দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ছিলেন। এপ্রিল মাসের প্রথমদিকে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ময়মনসিংহ থেকে হালুয়াঘাটের দিকে অগ্রসর হলে ভেরোনিকা সিমসাং ও সন্ধ্যারানী সাংমা মরিয়মনগর মিশনে আশ্রয় নেন। সেখানে থেকে তাঁরা চলে যান ভারতের মেঘালয় প্রদেশের মহেন্দ্রগঞ্জ থানার চাপাহাতি গ্রামে আত্মীয়ের বাসায়।
 
ভেরোনিকা সিমসাং ও সন্ধ্যারানী সাংমা ভারতের চাপাহাতি গ্রামে অবস্থান করছেন জেনে হালুয়াঘাটের জয় রামকুড়া খ্রীস্টান মিশনারি হাসপাতালের ডাক্তার ফিল্ড নার্সিং হাসপাতালে নিয়ে আসেন। বাঘমারা ক্যাম্পের অদূরেই ফিল্ড নার্সিং হাসপাতালটির অবস্থান ছিল।

ক্যাপ্টেন আব্দুল মান্নান ও ডাক্তার প্রেমাংকুর রায় সে হাসপাতালের দায়িত্বে ছিলেন। কিছুদিন সেখানে থেকে ভেরোনিকা সিংসাং আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা দেন।

১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের দিকে ভেরোনিকা সিমসাং ও তাঁদের মেডিক্যাল টিম ধানুয়া-কামালপুর হয়ে শেরপুর ও জামালপুরে প্রবেশ করেন। শেরপুর ২৯ দিন অবস্থান করে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা প্রদান করেন। জামালপুরের বিভিন্ন যুদ্ধে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা প্রদান করেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভেরোনিকা সিমসাং বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা প্রদানরত অবস্থায় ডিসেম্বরে জামালপুর হানাদার মুক্ত হলে দুজন ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সহযোগিতায় বাড়ি ফেরেন।  ভেরোনিকা সিমসাং ১৯৭৩ সালে টাঙ্গাইল জেলার মধুপুরের  বেড়িবাইদ গ্রামের খগেন্দ্র সাংমা ডিব্রাকে বিয়ে করেন। সেবিকা মুক্তিযোদ্ধা ভেরোনিকা সিমসাং ২০০৫ সালে ১৩ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁকে মধুপুরের বেড়িবাইদ গ্রামে সমাহিত করা হয়। পারিবারিক জীবনে তিনি লাকী সিমসাং, দীনা সিমসাং, দীপন সিমসাং নামে দুই কন্যা ও এক পুত্র সন্তানের জননী ছিলেন।
দেশকন্ঠ/এআর

 

  মন্তব্য করুন
আরও সংবাদ
×

আমাদের কথা

ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বব্যাপী অনলাইন মিডিয়া। গতি ও প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে মানুষও তথ্যানুসন্ধানে নির্ভরযোগ্য মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছে অনলাইন। যতই দিন যাচ্ছে, অনলাইন মিডিয়ার সঙ্গে মানুষের সর্ম্পক তত নিবিড় হচ্ছে। দেশ, রাষ্ট্র, সীমান্ত, স্থল-জল, আকাশপথ ছাড়িয়ে যেকোনো স্থান থেকে ‘অনলাইন মিডিয়া’ এখন আর আলাদা কিছু নয়। পৃথিবীর যে প্রান্তে যাই ঘটুক, তা আর অজানা থাকছে না। বলা যায় অনলাইন নেটওয়ার্ক এক অবিচ্ছিন্ন মিডিয়া ভুবন গড়ে তুলে এগিয়ে নিচ্ছে মানব সভ্যতার জয়যাত্রাকে। আমরা সেই পথের সারথি হতে চাই। ‘দেশকণ্ঠ’ সংবাদ পরিবেশনে পেশাদারিত্বকে সমধিক গুরুত্ব দিয়ে কাজ করতে বদ্ধপরির। আমাদের সংবাদের প্রধান ফোকাস পয়েন্ট সারাবিশ্বের বাঙালির যাপিত জীবনের চালচিত্র। বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের সংবাদও আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা একঝাক ঋদ্ধ মিডিয়া প্রতিনিধি যুক্ত থাকছি দেশকণ্ঠের সঙ্গে।