• সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১  নিউইয়র্ক সময়: ১৩:৪০    ঢাকা সময়: ২৩:৪০

নূপুর

সাইফ মুহিন : পাশের বাড়ির আপুর নাম নূপুর। দারুণ চটপটে মেয়ে। ছিপছিপে গড়নের দেখতে। আপুকে আমার এতো ভালো লাগতো! সবসময় চাইতাম আপুর সাথে সাথে থাকতে। তখন আমি সেভেনে পড়ি, আর আপু দেবে এসএসসি। আপু প্রায়ই বাড়িতে কেউ না থাকলে আমাকে বউ সাজিয়ে দিতো। আপুর অনেক ইচ্ছে ছিলো, বড় হয়ে বিউটি পার্লার চালু করবে।

সেদিন ছিলো শুক্রবার। শ্রাবণ মাসের বৃষ্টির সকাল। নূপুর আপু ছাতা মাথায় আমাদের বারান্দায় এসে উঁকি দিলো। আমি শুয়ে শুয়ে জাফর ইকবালের বই পড়ছিলাম, শাহনাজ ও ক্যাপ্টেন ডাবলু। বইটা বালিশের নিচে গুঁজে মাথা জাগালাম। আপু ছাতা বন্ধ করতে করতে বললো, 'কিরে গাধা, এখনো ঘুমাস! উঠ, তোরে নিয়া যামু এক জায়গায়। ঈদের সময় যে কিনছিলি, ওই গেঞ্জিডা পিন্দা রেডি হ।'
 
আমি নতুন গেঞ্জি পরে রেডি হয়ে বের হলাম আপুর সাথে। দুই ভাইবোন এক ছাতার নিচে হাঁটছি আর ভিজে চপচপ হয়ে যাচ্ছি। বড় সড়ক পেরিয়ে ভৈরব-ঢাকা হাইওয়ে থেকে বাসে উঠলাম। আমি তখনো জানিনা, আমরা কোথায় যাচ্ছি। তবে আমি মনে মনে বড্ড খুশি, বাসে উঠেছি, বাসে করে কোথাও যাচ্ছি। কেমন যেনো উৎসব উৎসব লাগছে। বাস থেকে নেমে রিকশা নিয়ে পৌঁছে গেলাম ব্রাহ্মন্দী নামক একটা জায়গায়। নরসিংদী সরকারি কলেজের কাছেই। রিকশা থেকে নেমে আপু মাথার চুল ঠিক করলো, ওড়না ঠিক করলো, ব্যাগ থেকে একটা লিপস্টিক বের করে ঠোঁটে ঘষলো। এরপর ভয়ে ভয়ে একটা বাড়ির ভেতরে ঢুকে দরজায় কড়া নাড়লো। বেশ কিছুক্ষণ পর একজন বয়স্ক মহিলা দরজা খুলতেই আপু জিজ্ঞেস করলো, "এটা কি হাসান ভাইদের বাড়ি?" ভদ্রমহিলা আপুকে ভেতরে নিয়ে গেলেন। আমি বসে রইলাম বারান্দায়। মিনিট বিশেক পর আপু বের হয়ে এলো বাড়ি থেকে। আপুর মুখটা থমথমে। রিকশায় বসে একটা কথাও বললো না আপু। বাসে উঠেই আপু আবার আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে গেলো। হাসছে, চুল আঁচড়াচ্ছে, তেতুলের আচার কিনে খাচ্ছে! আমি মুগ্ধ হয়ে থাকিয়ে রইলাম আপুর দিকে। কি সুন্দর হাসি! একদম মাধুরী  দীক্ষিতের মতো! আমি আপুকে জিজ্ঞেস করলাম, আপু ওটা কার বাসা? আপু বিড়বিড় করে বললো, "সে ভাবছে তারে ছাড়া আমি মইরা যামু। সে কেডা, যে ওরে ছাড়া আমি মইরা যামু! দুইমাস যাবত কোনো খবর নাই। বিয়ে করে ফেলছে, সেইটা আমারে বললেই হইতো। হুদাই ভিজ্যা ভিজ্যা ওরে খুঁজতে গেলাম। আমার কি মানুষের অভাব তুইই বল?"
 
আবার শুরু হলো তুমুল বৃষ্টি। ধান ক্ষেতের আইল ধরে হেঁটে হেঁটে বাড়িতে ফিরছি দুই ভাইবোন। দমকা হাওয়ায় ছাতা উলটে গেছে। সেটা দেখে আপু সেকি অট্টহাসি! "বুয়ার ছাতি নিয়া আইছিরে ছাইপ। কিন্তুক ছাতি দো গেলো ভাইঙ্গা। ছাতিও দেখতাছি বেডাগো মতো অল্প বাতাসে ভাইঙ্গা যায়, হিহিহি...."
 
বাড়ি ফিরে গোসল সেরেই কাথার ভেতরে ঢুকলাম। জ্বরে আমার গা পুড়ে যাচ্ছে। রাত দুইটায় ঘুমিয়েছিলাম জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকতে বকতে। পরদিন ঘুম ভাঙলো বেশ বেলা করেই। সকাল বেলা আর জ্বর নেই। চারদিক নিঝুম নিস্তব্ধ! আকাশে কি সুন্দর রোদ! প্রায় সপ্তাহ খানেক পর রোদ উঠেছে আকাশে। কিন্তু এই সোনা ঝরা সকালটাই হয়ে রইলো আমার জীবনের সবচেয়ে বেদনার সকাল! আমার শৈশবের একমাত্র সঙ্গী, আমার বোন, আমার মুগ্ধতার রাজকন্যা এই সকালেই চলে গেলো সবার অগোচরে! সিলিং ফ্যানের সাথে ঝুলন্ত নূপুর আপুকে নামিয়ে নিয়ে গেলো পুলিশের লোকেরা। একদিন পর দাফন হলো আপুর। ময়নাতদন্তে রিপোর্ট এসেছিলো, দুই মাসের প্রেগন্যান্ট ছিলো আপু। এই খবর ছড়িয়ে পরার পর পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয় স্বজন সবার মধ্যে ছি ছি পরে গেলো! কেউ তো বলেই ফেললো, বেশ হয়েছে মরেছে কলঙ্কিনীটা!
 
মরার মরেও  নূপুর নামক ষোল বছরের মেয়েটিকে নিয়ে তুমুল সমালোচনা চললো বছর খানেক। শুধু এগারো বছরের একটা বাচ্চা ছেলে পাগলের মতো খুঁজতো তার আপুকে। সে কোনো ভাবেই মানতে পারেনি এতো দ্রুত তাকে একা করে চলে যাবে তার একমাত্র ভরসার মানুষটা। সে ভাবতে পারেনি..... এখনো ভাবতে পারেনা। ভাবতে গেলেই শূন্য হয়ে যায় সবকিছু! সেই ছেলেটি আমি। 
 
আজ বেঁচে থাকলে নূপুর আপুর বয়স হতো ত্রিশ। আজ তার জন্মদিন। এই পৃথিবী তাকে ভুলে গেছে অনেক আগেই। কিন্তু আমি ভুলিনি। আমি বড় হয়েছি, কিন্তু এখনো আমার স্মৃতি জুড়ে রয়েছে নূপুর নামের সেই চটপটে মেয়েটি। যাকে কখনো কাঁদতে দেখিনি। যার হাসিটাই শুধু চোখে ভাসে। মাধুরী দীক্ষিতের মতো অনিন্দ্য সুন্দর সেই হাসি.......

  মন্তব্য করুন
আরও সংবাদ
×

আমাদের কথা

ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বব্যাপী অনলাইন মিডিয়া। গতি ও প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে মানুষও তথ্যানুসন্ধানে নির্ভরযোগ্য মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছে অনলাইন। যতই দিন যাচ্ছে, অনলাইন মিডিয়ার সঙ্গে মানুষের সর্ম্পক তত নিবিড় হচ্ছে। দেশ, রাষ্ট্র, সীমান্ত, স্থল-জল, আকাশপথ ছাড়িয়ে যেকোনো স্থান থেকে ‘অনলাইন মিডিয়া’ এখন আর আলাদা কিছু নয়। পৃথিবীর যে প্রান্তে যাই ঘটুক, তা আর অজানা থাকছে না। বলা যায় অনলাইন নেটওয়ার্ক এক অবিচ্ছিন্ন মিডিয়া ভুবন গড়ে তুলে এগিয়ে নিচ্ছে মানব সভ্যতার জয়যাত্রাকে। আমরা সেই পথের সারথি হতে চাই। ‘দেশকণ্ঠ’ সংবাদ পরিবেশনে পেশাদারিত্বকে সমধিক গুরুত্ব দিয়ে কাজ করতে বদ্ধপরির। আমাদের সংবাদের প্রধান ফোকাস পয়েন্ট সারাবিশ্বের বাঙালির যাপিত জীবনের চালচিত্র। বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের সংবাদও আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা একঝাক ঋদ্ধ মিডিয়া প্রতিনিধি যুক্ত থাকছি দেশকণ্ঠের সঙ্গে।