রমিজউদ্দিনের শরীরটা ভালো না। রোজা রেখে সারাদিন রিকশা চালান, তার উপর এই গরমে ষাটোর্ধ্ব একজন মানুষের শরীরে আর কত কুলাবে! সারাদিন রিকশা চালিয়ে রমিজউদ্দিন বারান্দায় পাটিতে শুয়ে আছেন। ইফতারের প্রতীক্ষা। মাগরিবের আজানের অপেক্ষা। রমিজউদ্দিনের স্ত্রী রাহেলা বেগম দুইটা আম আর দুই মুঠো চিড়া ভেজানো সামনে রেখে বসে আছেন। আজকের ইফতারের আইটেম। রমিজউদ্দিন ক্লান্ত গলায় বললেন, 'একটু শরবত করো নাই সুমনার মা?' রাহেলা বেগম কিছুই বললেন না। ঘরে চিনি বা গুড়, কিছুই নেই। উঠানের গাছে তিনটা লেবু ছিলো, বিক্রি করে দিয়েছেন আজ। চারদিকে মাগরিবের আজান শুরু হলো। রমিজউদ্দিন উঠে বসলেন। রাহেলা বেগম স্বামীর দিকে পানির গ্লাস এগিয়ে দিলেন।
রমিজউদ্দিন ও রাহেলা বেগমের চার মেয়ে। চার মেয়েরই বিয়ে হয়ে গেছে। বাড়িতে মানুষ বলতে বুড়া-বুড়ি দু'জনই। রমিজউদ্দিন বাড়ির সামনের এক টুকরো জমিতে সবজি চাষ করেন। প্রতিদিন একবেলা করে রিকশা চালান। এতেই পেটে ভাতে চলে যায় দু'জনের। আজকে অবশ্য রমিজউদ্দিন রিকশা-ভ্যান নিয়ে বের হননি। 'তোলা' পাঞ্জাবি গায়ে বের হয়েছেন, চার মেয়ের বাড়ি যাবেন। রাহেলা বেগম কয়েকদিন যাবত বলছেন, মেয়েদের শ্বশুরবাড়িতে 'ইফতারি' নিয়ে যেতে। বাপের বাড়ি থেকে ইফতারি না পাঠালে শ্বশুরবাড়ির লোকজন অনেক কথা শোনায় মেয়েদের। সমাজের মানুষ দশ কথা বলে। আর এটা তো যুগ যুগের ঐতিহ্য! না দিলে তো চলবে না। রমিজউদ্দিন মেজো মেয়ে রত্নার শ্বশুরবাড়ির পথে হাঁটছেন। দুপুরের প্রখর রোদ। দুই হাতে ইফতারের খাবার ভর্তি দুইটা বিশাল বাজারের ব্যাগ। কি একটা কারনে বাস চলাচল বন্ধ। রমিজউদ্দিন রিকশা নিতে চাইলেন, কিন্তু রিকশার দ্বিগুণ ভাড়া শুনে ভাবলেন, এই তো, সামনেই তো মেয়ের বাড়ি। অতটুকু পথ, হেঁটেই যাওয়া যাবে।
মেয়ের বাড়ির খাটে বসে আছেন রমিজউদ্দিন। মাথার উপর ফ্যান ঘুরছে। তারপরেও রমিজউদ্দিন খুব ঘামছেন। কান খাড়া করে আছেন পাশের ঘরের দিকে। মেয়ের শ্বাশুড়ি ব্যাগ থেকে একটি একটি করে খাবার, ফল বের করছে, আর কোনটার দাম আর মান কেমন, সেটা নিয়ে আলোচনা করছে। 'মিষ্টিডা মনে হয় দুই দিনের বাসি। ও রত্না, তোমার বাপেরে ঠকাইছে দোকানদার। তোমার শ্বশুর তো এই মিষ্টি খাবেনা মা! তরমুজটাও পঁচা। ভেতরে সাদা। বিয়াই-সাব কি কোনোদিন তরমুজ কিনে নাই? অমন পঁচা তরমুজ তো গরুতেও খায়না।' মেজো মেয়ে রত্নার শ্বশুরবাড়ি থেকে হাসিমুখে বিদায় নিলেন রমিজউদ্দিন। দুপুরের গনগনে রোদ। রত্নার চোখে জল, 'বাবা, ইফতারডা কইরা যাও। এই রইদ্যে বার হইয়োনা বাবা।' রমিজউদ্দিন মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে হাঁটা ধরলেন। বসে থাকলে চলবে না। বাকী তিন মেয়ের বাড়িতেও যেতে হবে বেলা থাকতে থাকতে। রমিজউদ্দিন বড় ডিস্ট্রিক্ট সড়ক ধরে হেঁটে হেঁটে চলে গেলেন অনেক দূর। গুটিগুটি পায়ে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত এক বাবা হেঁটে যাচ্ছে অতবড়, অত ওজনের একটা ব্যাগ টানতে টানতে! রত্না আম গাছটার নীচে দাঁড়িয়ে অপলক চোখে তাকিয়ে রইলো বাবার দিকে, যতদুর যতক্ষণ দেখা যায় বাবাকে, ঠিক ততক্ষণ.........