দেশকণ্ঠ প্রতিনিধি, কালীগঞ্জ (গাজীপুর) : গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার বক্তারপুর ইউনিয়নের ফুলদী বাজারে চার দশক ধরে ঐতিহ্যবাহী কামলার হাটের বিস্তৃতি দিন দিন বেড়েই চলেছে। ধান কাটার মৌসুমে বিভিন্ন জেলা থেকে দৈনিক হাজিরায় শ্রম বিক্রি করতে আসা এসকল শ্রমিকের সংখ্যা কয়েক হাজার ছাড়িয়ে যায়। শ্রমিকরা ভোর থেকে শ্রম বিক্রির আশায় ফুলদী বাজারের জনতা উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে ভিড় জমায়। যা এলাকায় ‘কামলার হাট’ নামে পরিচিত।
আশে পাশের গ্রামসহ উপজেলার দূর দূরান্তের কৃষকরা দৈনিক মুজুরীর ভিত্তিতে কামলার হাট থেকে প্রয়োজন অনুসারে শ্রমিকদের নিয়ে যায়। দিন শেষে এসকল শ্রমিকরা শ্রম বিক্রির টাকা নিয়ে আবারও ফিরে আসে ফুলদী বাজারে। এছাড়া জমিতে ধানের লাগানোর সময়ও এসকল শ্রমিকের আগমন ঘটে কামলার হাটে। মূলত বৈশাখ মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে কামলার হাটে ধান কাটার শ্রমিকরা সমবেত হতে থাকে। শুরুতে দৈনিক ৪০০ টাকা হাজিরা দিয়ে কাজ শুরু করে শ্রমিক সংকটের কারণে বর্তমানে হাজিরা ১০০০ টাকা পর্যন্ত এসে ঠেকেছে। যদিও বৈশাখ মাসের মাঝামাঝি দৈনিক হাজিরা ১৪০০ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা এসকল শ্রমিকদের জন্য ফুলদী বাজারে ব্যবসায়ীদের বেচা বিক্রি অন্য যে কোন সময়ের তুলনায় দ্বিগুণ হয়ে থাকে।
এলাকার কৃষক ও বয়োজেষ্ঠ্য শ্রেণির মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আশির দশকের শুরু থেকে ধান কাটার শ্রমিকরা শ্রম বিক্রির জন্য এই এলাকায় আসতে শুরু করে। শুরুতে পার্শ¦বর্তী নরসিংদী জেলার মনোহরদি থেকে শ্রমিকরা এসে কাজ শুরু করেন। পরে ময়মনসিংহ ও জামালপুর জেলার শ্রমিকরা দৈনিক হাজিরা ভিত্তিতে কাজ শুরু করেন। বর্তমানে রংপুর, গাইবান্ধা, নীলফামারি ও কুড়িগ্রাম জেলার শ্রমিকরাও শ্রম বিক্রির উদ্দেশ্যে কামলার হাটে এসে ভিড় জমান।
শ্রমিকদের অনেকেই আবার কালীগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করা শুরু করেছেন। কেউ কেউ বিয়েসাদী করে স্থায়ী বাসিন্দা বনে গেছেন। তাদেরই একজন রবিউল ইসলাম। নীলফামারি সদর উপজেলার এ তরুন গত একযুগ ধরে বাস করছেন ফুলদী গ্রামে। ধান কাটার সময় বাদে বছরের অন্য সময় জীবিকার প্রয়োজনে ‘যখন যে কাজ পান, তাই করেন’। ফুলদীকে নিজের জন্মস্থানের মতোই ভালবেসে ফেলেছেন রবিউল। তিনি বলেন, আমি যখন প্রথম ফুলদী আসি, তখন আমার বয়স মাত্র ১৪ বছর। এই এলাকার মানুষগুলো খুব ভাল। তাঁদের আদর, স্নেহ ও ভালবাসার কারণে আমি এখন আর বাড়ি যাইনা। এখানেই ভাড়া বাসায় থেকে কাজ করছি। তার মতো আব্দুল মালেক ও আবু কালামরাও স্থায়ীভাবে বাস করছেন ফুলদী গ্রামে।
টানা তৃতীয় বছরের মতো এবারও কাজ করতে আসা কুড়িগ্রাম জেলার হাবিজউদ্দিন বলেন, ‘একজন শ্রমিক হিসেবে আমি অনেক ধরনের কাজই করে থাকি। তবে কালীগঞ্জে আসলে যেন নিজের এলাকার মতোই মনে হয়। যদিও মাঝে মধ্যে অনেকেই কাজে নিয়ে খারাপ ব্যবহার করেন। তবে বাকিরা সবাই আমাদের প্রতি অনেকটাই সদয়’। একটা সময় শ্রমিকরা বিভিন্ন বাড়িতে বিনা মূল্যে থাকতে পারতেন। কিন্তু এখন প্রতি রাত অন্যের বাংলা ঘর বা বারান্দায় ১০/১৫ টাকার বিনিময়ে থাকতে হয়। তবে যারা স্কুল মাঠে রাত কাটানোর সুযোগ পান তাদের কোন ভাড়া দিতে হয় না।
শ্রমিকদের আগমনের এ সময়টাতে বাজারে বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা প্রসার ঘটে। পার্শ্ববর্তী পলাশ উপজেলার মো. শুক্কুর আলী পুরনো শার্ট-প্যান্ট নিয়ে এসেছেন। গত ১৫ বছর যাবত তিনি এই ব্যবসা করে থাকেন। বিক্রি ভাল বলে জানিয়েছেন তিনি। এছাড়া নতুন কাপড় ও হোটেলের জমজমাট ব্যবসা হয়ে থাকে ফুলদী বাজারে। বাজারের হোসেন মেডিক্যাল হলের স্বত্তাধিকারী তোফাজ্জল হোসেন বলেন, ‘অন্য যে কোন সময়ের চেয়ে ধান কাটার মৌসুমে ঔষধ বিক্রি দ্বিগুণ বেড়ে যায়। আমরা ব্যবসায়ীরা তাদের সাথে ভাল ব্যবহার করি, যাতে করে তারা ভবিষ্যতেও আমাদের এলাকায় আসেন’।
উপজেলার ধান লাগানো ও কাটার ক্ষেত্রে পুরোপুরি বাইরের শ্রমিকের উপর নির্ভর থাকলেও ২০২০ সালে করোনার সময় তারা কেউ আসতে পারেনি। তখন নিজ নিজ এলাকার ‘মৌসুমি’ শ্রমিক দিয়েই কৃষকদের ধান কাটার কাজ করতে হয়েছে।
সকালে ও সন্ধ্যার পর ফুলদী বাজারে শ্রমিকদের ভিড়ের কারণে একটা উৎসবের আমেজ লক্ষ্য করা যায়। ধান রোপন ও কাটার মৌসুমে শ্রমিকদের পদচারনায় মুখর থাকে ফুলদী বাজার। ভবিষ্যতেও এ ধারা অব্যহত থাকবে বলেই প্রত্যাশা এখনকার কৃষকদের।
দেশকণ্ঠ/আসো