• বৃহস্পতিবার, ১৬ মে ২০২৪, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১  নিউইয়র্ক সময়: ১৪:৫৬    ঢাকা সময়: ০০:৫৬
সাইফ মুহিন

মায়ের কান্দন যাবজ্জীবন

আমি রতন। বাড়ি ময়মনসিংহ জেলার ভালুকা থানায়। খুব ছোটবেলায় আমার বাবা মারা যায়। তখনকার স্মৃতি আমার কিছুই মনে নেই, অনেক ছোট ছিলাম। যখন একটু বড় হলাম, মক্তবে যাই যখন, তখনই এলাকায় আমার মায়ের সম্পর্কে বিভিন্ন গুঞ্জন শোনতাম। নেতিবাচক গুঞ্জন। আমার মা ভালো নয়। কিন্তু খুব ছোটবেলা থেকেই আমার মা'কে আর দশটা মহিলার থেকে ভালো মনে হতো আমার কাছে। স্কুলে না গেলে সবার মা তাদের বাচ্চাদের মারতো, কিন্তু আমার মা কোনোদিন আমার গায়ে হাত তোলেনি। আমি যেদিন স্কুলে যেতাম না, সেদিন মা আমাকে কোলে নিয়ে মাথায় তেল দিয়ে দিতো, কপালে কাজলের টিপ দিয়ে দিতো। কত আদর! যখন বলতাম, "মা পেট বেদনা করতাছে। আইজকা ইশকুলে যাইতাম না!" তখন মা বকা দিতো না। হাসতো। রিনরিন করে হাসতো। খুব সুন্দর ছিলো আমার মায়ের হাসি। টিভিতে দেখা একটা নায়িকার হাসির মতো একদম।
 
মা সারাদিন বাসায় থাকলেও রাতে বাসায় থাকতো না। মা অনেক দূরে, ইস্টিশনের ওপারে জুটমিলে চাকরী করতো। প্রতিদিন নাইট ডিউটি থাকতো মায়ের। আমি ঘুমাতাম নানীর সাথে। নানি আমাদের বাসায়ই থাকতেন। নানীর এক পা ছিলো পঙ্গু, হাঁটতে পারতো না। সন্ধ্যাবেলা আমি মাদুর বিছিয়ে সুর করে পড়তাম। মা চোখে কাজল দিতো, লাল শাড়ি পরতো! এরপর আমাকে আর নানীকে দুধ দিয়ে ভাত মেখে খাইয়ে চলে যেতো। ফিরতো সেই সকাল বেলা। তখন আমি ঘুম থেকে জেগে মক্তবে চলে যেতাম আরবী পড়তে।
 
*
তখন আমার বয়স চৌদ্দ বছর। নাইনের ক্লাস সবে শুরু হয়েছে। তখনো এলাকায় আমার মা'কে নিয়ে গুঞ্জন। আমি কান দেইনা। কেউ সামনাসামনি কিছু বলেনা। একদিন টিফিনের সময় ক্লাসের কয়েকজন বললো, "চল বই (মুভি) দেখতে যাই। ছায়াবাণি সিনেমা হলে সালমান শাহর বই আসছে, যাবি?" আমি কখনো সিনেমা দেখিনি। সেদিন গিয়েছিলাম ময়মনসিংহের সিনেমা হলে। ছবি দেখা শেষ করে বের হতেই আমার ক্লাসমেট জহির আঙুল দিয়ে দেখালো, "এই দ্যাখ দ্যাখ নডি বেডি। এইগুলা বেশ্যা মাইয়ালোক!" আমি তাকালাম। খানিক দূরে একজন মোটামতো ভদ্রলোকের হাত ধরে আমার মা হেসে কুটিকুটি! মায়ের শাড়ির ফাঁকে পেটের অর্ধেকটাই বের হয়ে আছে!
 
প্রচন্ড রাগ আর ঘৃণা নিয়ে বাড়ি ফিরেছিলাম সেদিন। ভেবেছিলাম যত রাগ, কষ্ট, দুঃখ সব মায়ের উপর ঢেলে কোথাও চলে যাবো একা একা! কিন্তু বাড়িতে গিয়ে দেখি আমার নানী মরে পরে আছে বিছানায়। নানীর মৃত্যুর দুঃখ 'পতিতা' মায়ের প্রতি ঘৃণাটা সাময়িকভাবে ধামাচাপা দিয়ে দিলো! নানীর মৃত্যুর পর আমার মা অনেকটাই বদলে গেলো! আগের মতো আর হাসেনা, কাজে যায়না। চোখের নীচেও কালো হয়ে গেছে। তখন ঘৃণার বদলে মায়ের জন্য মায়া লাগতো। একদিন দুপুরে ঘুমাচ্ছিলাম। শুক্রবার ছিলো। হঠাৎ মায়ের কান্নার আওয়াজ শুনেই আমার ঘুম ভেঙে গেলো। মা আমাকে দেখে কিছু কাগজপত্র লুকালো বিছানার নীচে। আমি পরবর্তীতে কাগজ গুলো পড়েছিলাম। সব নানীর চিকিৎসার কাগজপত্র। মোট তিনলক্ষ টাকা খরচ হয়েছে নানীর পিছনে। কিন্তু মা বাঁচাতে পারেননি নানীকে। তিনলক্ষ টাকা একা যোগার করেছে আমার মা, উনার মা'কে বাঁচিয়ে তোলার জন্য। আমার ভাবনাটাই পালটে গেলো মায়ের প্রতি। কিশোর বয়স ছিলো, তবু হিসেব মিলিয়েছিলাম সেদিন। চুরানব্বই সালে তিনলক্ষ টাকা কম কথা নয়!
 
আমি মেট্রিক দেবো। মাকে বললাম। মা সেকি খুশী! বহুদিন পর মা সেদিন সাজলো। চোখে কাজল দিলো। একটু পর ভাত বেড়ে আমার সামনের চেয়ারে এনে প্লেটটা রাখলো! "তোরে একা রাইখ্যা গেলাম ঘরে। ভাত খায়া লইস। দুয়ার ভালা কইর‍্যা লাগায়া ঘুমাবি।" আমি লজ্জিত চোখে বললাম, "মা, তুমি কই যাও?" মা অপরাধীর মতো জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। বললো, "জুটমিলে যাই। দেহি কোনো কাম পাইনি। তোর পরীক্ষা সামনে!"
 
আমি সেদিন মায়ের পিছু নিয়েছিলাম। মা হাঁটছে তো হাঁটছেই। অনেক দূরে একটা রেলস্টেশন। সেই স্টেশনে গিয়ে থামলো মা। আমি মানুষের ভীড়ে মিশে গেলাম। মা টং দোকানে বসে চা খেলো। একটু পরেই কোর্ট টাই পরা এক ভদ্রলোক এসে মা'কে গাড়িতে তুলে নিয়ে গেলো। রাস্তার অন্ধকার কেটে কেটে মায়ের গাড়ি দূরে মিলিয়ে গেলো। অচেনা এক পুরুষ মানুষ আমার মা'কে আজকের জন্য কিনে নিয়ে গেলো!
 
আমার পরীক্ষা শেষ। একদিন সন্ধ্যাবেলা বাসায় গিয়ে দেখি মা প্রচন্ড জ্বরে কাঁপছে। ভয়ানক জ্বর। আমি মায়ের উপরে কম্বল চেপে ধরলাম। মা কাঁপছে, অথচ হাসি-হাসি মুখে একটা দলিল আমার হাতে ধরিয়ে দিলো! "বাপজান, সারাজীবন ভাড়া বাড়িতে থাকছি। নিজেগো বাড়ি নাই। তোমার বাপের ও বাড়ি নাই। এই ভাড়া বাড়িতেই আইজকা বিশ বছর যাবত আছি। এই নেও বাপ, বাড়ির দলিল। নয়া বাজারের পিছে তোমার বারেক মামার বাড়িডা আমি কিনছি। আমার পোলায় মেট্রিক পাশ করবো, থাকবো কি মাইনষের বাড়িতে?" আমি দলিলটা হাতে নিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরলাম। প্রচন্ড কান্না পাচ্ছিলো আমার। মা আমার মাথা মায়ের বুকে চেপে ধরলো, "পাগলা বেটা আমার, পুরুষ মাইনষের কান্দন ভালা না।"
 
*
আমি মেট্রিক পরীক্ষায় সেকেন্ড ডিভিশন পেয়ে পাশ করেছি। আর পড়বোনা বলে গো ধরেছি। মাও জোর করেনি। মা'কে নিয়ে চলে এসেছি গাজীপুর। টঙ্গিতে এক গার্মেন্টসে চাকরী নিয়েছি, সুপারভাইজার হিসেবে। বোর্ডবাজারে একটা বাসা নিয়েছি। একরুম। এই সময় মায়ের শরীরটা ভালো যাচ্ছিলোনা। মহাখালি নিয়ে গেলাম বড় ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার গোলাম সারওয়ার, বিখ্যাত ডাক্তার! কিন্তু মায়ের শরীর ঠিক হচ্ছিলোনা! একদিন ফ্যাক্টরিতে প্রচন্ড কাজ! দম ফেলার ফুসরৎ নেই। হঠাৎ নীচতলার দাড়োঁয়ান এসে বললো, "রতন ভাই, তোমার অহনি বাসায় যাওয়া লাগবো। তোমার বাসা থেইক্যা লোক আসছে।" আমি বাসায় গেলাম! দিনটা ছিলো উনিশশো ছিয়ানব্বই সালের বাইশে নভেম্বর। আমার মা সেদিন দুনিয়ার সব খেলা শেষ করে পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়। আমি একদমই এতিম হয়ে যাই। মায়ের মুখটা সেদিন অদ্ভুত সুন্দর দেখাচ্ছিলো! জনমদুখিনী মা'কে আমি ধরে রাখতে পারিনি। যেমন পারেনি আমার মা ও, তার মা'কে ধরে রাখতে!
 
*
২০২৩ সাল। আমি এখন বিবাহিত চল্লিশোর্ধ্ব একজন পুরুষ। গাজীপুরে আমার নিজেরই খুব ছোট্ট একটা গার্মেন্টস আছে। আত্মীয় স্বজনরা মাঝেমধ্যে কানাঘুষা করে আমাকে নিয়ে। সুমনাকে নিয়ে আমি সব জায়গায় যাই। আমি গর্ব করি সুমনাকে নিয়ে। সুমনা আমার স্ত্রী! প্রথম প্রথম সুমনা আমাকে বলতো, "কল গার্ল ছিলাম, একদম ঘরের বৌ করে নিলে! এত ভরসা!" আমি বলতাম, "উনিশ বছরের একটা মেয়ে পাঁচজনের একটা সংসার একা চালাতো, সেই মেয়ে কলগার্ল কি করে হয়, সে তো যোদ্ধা! আমি শুধু একজন সৎ যোদ্ধাকে হার মানতে দেইনি। যেমন হার মানেনি আমার মা...।
দেশকণ্ঠ/আসো
 

  মন্তব্য করুন
×

আমাদের কথা

ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বব্যাপী অনলাইন মিডিয়া। গতি ও প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে মানুষও তথ্যানুসন্ধানে নির্ভরযোগ্য মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছে অনলাইন। যতই দিন যাচ্ছে, অনলাইন মিডিয়ার সঙ্গে মানুষের সর্ম্পক তত নিবিড় হচ্ছে। দেশ, রাষ্ট্র, সীমান্ত, স্থল-জল, আকাশপথ ছাড়িয়ে যেকোনো স্থান থেকে ‘অনলাইন মিডিয়া’ এখন আর আলাদা কিছু নয়। পৃথিবীর যে প্রান্তে যাই ঘটুক, তা আর অজানা থাকছে না। বলা যায় অনলাইন নেটওয়ার্ক এক অবিচ্ছিন্ন মিডিয়া ভুবন গড়ে তুলে এগিয়ে নিচ্ছে মানব সভ্যতার জয়যাত্রাকে। আমরা সেই পথের সারথি হতে চাই। ‘দেশকণ্ঠ’ সংবাদ পরিবেশনে পেশাদারিত্বকে সমধিক গুরুত্ব দিয়ে কাজ করতে বদ্ধপরির। আমাদের সংবাদের প্রধান ফোকাস পয়েন্ট সারাবিশ্বের বাঙালির যাপিত জীবনের চালচিত্র। বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের সংবাদও আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা একঝাক ঋদ্ধ মিডিয়া প্রতিনিধি যুক্ত থাকছি দেশকণ্ঠের সঙ্গে।