এসএম আবুল হোসেন : অনগ্রসর ও অবহেলিত এক জনপদের নাম ছিল বিক্রমপুর। সেই বিক্রমপুরকে দেখছি বদলে যেতে। ছেলেবেলায় আমার কাছে পদ্মা নদীকেই মনে হতো বিশাল সাগর। তখন নদীতে এমন চর পরতে দেখিনি। এপার থেকে ওপারের কিছুই দেখা যেত না। পদ্মা তীরে বালির উপর আছড়ে পড়ত ঢেউ। আমরা পা ভিজাতাম বা খালি পায়ে হেঁটে বেড়াতাম। যে স্থানে এখন পদ্মা সেতু দাঁড়িয়ে আছে ঠিক তার নীচে তপ্ত বালুতে ছোট বেলা ফুটবল খেলতাম।
সত্তর ও আশি দশকে মাওয়া বাজারটা থাকত ফাঁকা। সকালে কয়েক ঘণ্টা জমজমাট; এরপর থেকেই মানুষ জন খুব একটা থাকতো না। পদ্মার তীরে সারি সারি বেদের নৌকার বহর বাধা থাকত। পদ্মা পাড়ের এই বেদেদের জীবন নিয়ে পল্লী কবি জসিম উদ্দিন গান লিখেছেন- বাবু সেলাম বারে বার, আমার নাম গয়া বাইদ্যা বাবু বাড়ি পদ্মার পার। পদ্মা পাড়ে মাওয়া বাজার এখন রাত দিন জমজমাট থাকলেও আগে কয়েকটি মুদি দোকান, মিষ্টির দোকান আর দুটি ফার্মেসি সারাদিন খোলা থাকত। কিন্ত খরিদদার থাকতো কম। সন্ধ্যায় আবার জমতো মুরব্বিদের আড্ডা। একটা রেডিও থাকত আড্ডার মাঝে। এন্টেনা তুলে বিবিসি আর ভয়েস অব আমেরিকার সংবাদ শুনতো। মাঝে মাঝে আওয়াজ না আসলে রেডিওকে চারিপাশে ঘুরানো হতো। টিনের চালের সাথে এন্টেনা ঠেকিয়ে আরথিনের কাজ সারা হতো। দুই পল্লী ডাক্তার কুটু মিয়া আর বাসু ডাক্তার ছিলেন এলাকার আস্থার প্রতীক। নদীর তীরে দাঁড়িয়ে থাকলে দেখা যেত ইলিশ ধরার নৌকাগুলো জাল ফেলছে আর জাল ভর্তি করে রূপালী ইলিশ তুলছে। এখন ইলিশ ধরার নৌকা দেখা গেলেও রূপালী ইলিশ আর তেমন জালে উঠতে দেখা যায় না। ঢাকার বাসা থেকে গ্রামের বাড়ি মাওয়া যেতে আগে সময় লাগত ছয় ঘণ্টা থেকে সাত ঘণ্টা। নৌপথে দুটি রুট ছিল। একটি সদরঘাট থেকে লঞ্চ যোগে বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী দিয়ে শাপের চর, কুচিয়ামারা, সৈয়দপুর, শেখরনগর হয়ে শ্রীনগর পর্যন্ত। খালে পানি কম থাকলে অনেক সময় আলমপুর নামিয়ে দেয়া হতো। তারপর নৌকায় বা পায়ে হেঁটে বাড়ি পৌঁছতাম। আরো একটি নৌরুট ছিল সদরঘাট থেকে মুন্সিগঞ্জের কাঠপট্টি, রিকাবি বাজার, বেতকা ডহুরি হয়ে প্রমত্ত পদ্মার বুকে ভেসে জসিলদা ঘাটে লঞ্চ ভিরত। সময় লাগতো আট নয় ঘণ্টা। বাড়ির পাশ দিয়ে একটা খাল প্রবাহিত ছিল (এখন এটা নর্দমা বলা যায়)। পদ্মা নদীর জসিলদা এলাকা ছিল খালের মুখ। এই খালটি গোয়ালি মান্দ্রা হাটের সামনে দুই দিকে বিভক্ত হয়েছে। ডান পাশ হলদিয়া, লৌহজং হয়ে পদ্মায় মিশেছে। বাম পাশ দিয়ে শ্রীনগর হয়ে ধলেশ্বরী নদীতে মিশেছে।
বর্ষা মৌসুমে এই খালে পাওয়া যেত অনেক মাছ। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পদ্মায় চলাচল করতে দেখেছি পাক হানাদার বাহিনীর যুদ্ধ জাহাজ। চাঁদপুর, নারায়ণগঞ্জ থেকে পাক যুদ্ধজাহাজ গোয়ালন্দ হয়ে যাতায়াত করতো। ধান ক্ষেতে পাক হানাদারদের হেলিকপ্টার নামতে দেখে ভয়ে আতঙ্কে মুহুর্তের মধ্য গ্রাম শুন্য হয়ে যেতে দেখেছি। হেলিকপ্টার থেকে নামানো হতো গোলাবারুদের বাক্স। সেই বাক্স তোলা হতো পদ্মায় নোঙ্গর করা পাক বাহিনীর যুদ্ধ জাহাজে। শীতের সকালে ঘরে ভাজা মুড়ি আর খেজুরের রসের সেই স্বাদ যেন এখনো পাই। খোলা প্রান্তরে দাঁড়ালে যতদুর চোখ যেত শুধুই শষ্য খেত। কলাই, কাউয়াইন আর মিষ্টি আলুর খেতগুলো দেখলে চোখ জুড়িয়ে যেত। মাওয়া থেকে নানীর বাড়ি কাজির পাগলা যেতাম খেতের আইল দিয়ে হেটে হেটে। পাশাপাশি দুটি ইউনিয়ন মেদিনীমণ্ডল এবং কুমারভোগ। বর্তমান ঢাকা মাওয়া সড়ক দুটি ইউনিয়নকে বিভক্ত করেছে। পদ্মা ব্রীজের সমস্ত কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন হয়েছে কুমার ভোগে।
মঙ্গলবার ছিল গোয়ালি মান্দ্রা হাট।এই হাটটি ১৫০ বছরের পুরানো। তখন রবিবার সরকারি ছুটি থাকলেও বিক্রমপুরের অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হাট উপলক্ষে মঙ্গলবার ছুটি থাকতো। হাটের দিন সকাল থেকেই চারিদিক থেকে মানুষের ঢল নামতো হাট অভিমুখে।আমার কাছে হাটের মুল আকর্ষন থাকতো শংকরের দোকানের ঘোল আর নুরু চাচার মুরালি। ৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে এই গোয়ালি মান্দ্রা হাটে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে পাক হানাদার বাহিনীর মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়েছিল। পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে এই যুদ্ধে সরাসরি অংশ নিয়েছিলেন সাংবাদিক নেতা শাজাহান মিয়া [ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন এবং বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি] এবং সাংবাদিক নেতা স্বপন দাস গুপ্ত এবং স্বপনদার ছোট ভাই সাংবাদিক শেখর দাস গুপ্ত। ত্রিমুখী এই আক্রমণে দিশেহারা হয়ে পরেছিল পাক বাহিনী। পরে পাক বাহিনী হাটের অনেক দোকানে অগ্নিসংযোগ করে। এই যুদ্ধের সময় আমি ছিলাম নানী বাড়ি কাজিরপাগলা। হাট থেকে আধা কিলোমিটার দূরে। নদী, খাল, বিল পরিবেষ্ঠিত এই বিক্রমপুরে খবরের কাগজ পৌঁছাততো সন্ধ্যায়। মুক্তিযুদ্ধের পর দেখেছি নকশাল বা সর্বহারা পার্টির তাণ্ডব। সর্বহারাদের ধরতে অভিযান চালাতো রক্ষী বাহিনী। তৎকালীন দুই আওয়ামী লীগ নেতা কোরবান আলী ও শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের দ্বন্দে বিক্রমপুরের কোনো উন্নয়ন হয়নি। কখনো কল্পনা করিনি বিক্রমপুরের উপর দিয়ে ইঞ্জিন চালিত গাড়ি চলবে। অথচ এখন হুইসেল বাজিয়ে ট্রেন ছুটে চলছে।
দেশকণ্ঠ//