দেশকন্ঠ অনলাইন : জেলায় ভয়াবহ বন্যায় কৃষিখাতে অপরিসীম ক্ষতি হয়েছে। খাদ্য নিরাপত্তায় শঙ্কার মাধ্যে এবার কৃষকের নতুন ভীতি ফসলে পোকার মারাত্মক আক্রমণ। কৃষি কর্মকর্তাদের মতে, কালো বর্ণের এ ভয়ঙ্কর পোকার নাম ফল আর্মিওয়ার্ম। সোনাগাজী এবং ফুলগাজী উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ফসলি জমি ও জনপদে এ পোকার অস্বাভাবিক উপদ্রব দেখা দিয়েছে। পোকার এ উপদ্রবকে মহামারী হিসেবে দেখছেন স্থানীয় কৃষকরা।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, সাপ্তাহখানেক আগ থেকে সোনাগাজীর আমিরাবাদ ও ফুলগাজীর বিভিন্ন ইউনিয়নে ফসলি জমিসহ বিভিন্ন স্থানে এ পোকার আক্রমণ দেখা দিয়েছে। সোনাগাজীতে বন্যার পানিতে এ পোকা ভেসে এসেছে বলে ধারণা করছেন স্থানীয় কৃষকরা। কৃষি বিভাগ বলছে, ফসলের জন্য ক্ষতিকর এ পোকা দমনে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করেছেন তারা। অন্যদিকে কৃষকরা বলছেন, জমিতে কীটনাশক প্রয়োগ করেও পোকা দমন করা যাচ্ছে না।
গত শনিবার সোনাগাজীর উপজেলার আমিরাবাদে গিয়ে দেখা যায়, কালো বর্ণের অসংখ্য পোকা ফসলের মাঠে, রাস্তায়, বাড়িঘর এবং আশপাশের বন-জঙ্গলে বিচরণ করছে। কৃষি কর্মকর্তাদের মতে এ পোকা পানিতে থাকতে পারে না। তবে সরেজমিনে দেখা মিলেছে বিপরীত চিত্রের। পুকুর, ডোবা-নালাসহ আমন ধানের মাঠে পানি থাকলেও পোকাগুলো পানির ওপর দিয়েই হেঁটে বেড়াচ্ছে এবং একস্থান হতে অন্যস্থানে যাচ্ছে।
স্থানীয় কৃষকরা জানান, বন্যার পর জমিতে ফের আমন ধান লাগিয়েছেন তারা। এছাড়া বন্যার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে আগাম শীতকালীন ফসল লাউ, কুমড়া, করলা, জিঙ্গা, পাট শাক, চিচিঙ্গা আবাদ করেছেন, সাপ্তাহখানেক পর সেগুলো বিক্রির উপযোগী হত। এরই মধ্যেই শুরু হয়েছে এ পোকার ব্যাপক আক্রমণ। পোকার আক্রমণ কমাতে জমিতে কীটনাশক ছিটিয়েও কোনো কাজ হচ্ছে না। পোকার আক্রমণে ফসল উৎপাদনে বিপর্যয়ের শঙ্কা করছেন তারা। একই কথা বলছেন ফুলগাজী উপজেলার কৃষকরাও। সেখানেও ফসলের মাঠে এ পোকার আক্রমণ প্রকট আকার ধারণ করেছে।
সোনাগাজীর আমিরাবাদ ইউনিয়নের আহম্মদপুর, চর কৃষ্ণজয় এলাকায় এবং লেমুয়া ইউনিয়নের কসবা, ধর্মপুর, নিরগঞ্জ এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, কৃষকের পাট শাক, কলমির শাক, শিম, কুমড়ো, লাউ, ঝিঙ্গে, বেগুন গাছের পাতা এবং কান্ডে কালোবর্ণের এ পোকার উপস্থিতিতে গাছের সবুজ রং কালো দেখাচ্ছে। রাস্তাঘাট, পুকুর, ডোবা-নালা, ফসলবিহীন জমির ঘাসসহ সর্বত্র এ পোকার উপদ্রব দেখা গেছে। এ পোকার আক্রমণে ধানসহ অন্যান্য উদ্ভিদের পাতা শুকিয়ে বাদামী হয়ে পড়ছে।
আমিরাবাদের আহম্মদপুরের কৃষক সাইফুল ইসলাম বলেন, ১২ শতক জমিতে লাউ গাছের লাগিয়েছিলাম। হঠাৎ এ পোকা এসে সবগুলো গাছের পাতা খেয়েছে এবং গোড়ায় আক্রমণ করেছে। এতে লাউ গাছগুলো শুকিয়ে মারা গেছে। কৃষি অফিসের পরামর্শে কীটনাশক প্রয়োগ করেও লাভ হয়নি। পোকাগুলোকে কীটনাশকের পানিতে রাখলেও সেগুলো মরে না।
আহম্মদপুর এলাকার কৃষক সিরাজুল হক বলেন, ৬ শতক জমিতে লাগানো পাট শাক খেয়ে ফেলেছে পোকা।
আমিরাবাদের চর কৃষ্ণজয় গ্রামের বাসিন্দা আবুল কালাম বলেন, এত পোকা আমার ৫৫ বছরের জীবনে কখনো দেখিনি। দেখতেও ভয় লাগে, কাছে গেলে গায়ে উঠে যায়। বাড়িঘরে ঢুকে পড়েছে সেগুলো।
একই চিত্র দেখা গেছে ইউনিয়নের কাতু সদাগর বাড়িতেও। এই বাড়ির কৃষক মোস্তফা বলেন, বন্যার ক্ষতি কাটাতে ৬০ শতক জমিতে আগাম শাক-সবজি লাগিয়েছি। এখন সেগুলোও পোকায় খেয়ে ফেলছে। কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, আর্মিওয়ার্ম পৃথিবীব্যাপী একটি ক্ষতিকারক পোকা হিসেবে পরিচিত। এটি প্রায় ৮০ প্রকার ফসলে আক্রমণ করে থাকে।
এ ব্যাপারে সোনাগাজী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাঈন উদ্দিন আহমেদ সোহাগ বলেন, এ পোকার আক্রমণ থেকে ফসল রক্ষায় কৃষকদের বিভিন্ন পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া পোকা দমনে ইউনিয়ন পর্যায়ে আমাদের দল কাজ করছে। এটি দমনে কৃষকদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করছে কৃষি বিভাগ।
এ ব্যাপারে ফুলগাজী উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মোঃ খোরশেদ আলম জানান, ফুলগাজীতে এ পোকার উপদ্রব ঠেকাতে তিন ধরনের ওষুধ ছিঁটানো হয়েছে। কৃষকদের একাধিক ওষুধের মিশ্রণ প্রসঙ্গে জানানো হয়েছে এবং তা ব্যবহার করতে বলা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, বন্যার সময় কিছু কীটের লার্ভা ফসলের মাঠে আগাছায় থাকার ফলে এ পোকা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফুলগাজীর আমজাদহাট ইউনিয়নের মলিপুরেও এমন পোকা দেখা মিলেছে। তবে মুন্সীরহাটের দক্ষিণ শ্রীপুরে এর প্রাদুর্ভাব বেশি লক্ষ্য করা গেছে।
কেবল ফসলের মাঠ নয়, ঘরে বাড়িতেও এ ফল আর্মিওয়ার্ম পোকার প্রকট উপদ্রব বেড়েছে। সোনাগাজীর আমিরাবাদ ইউনিয়নের চর কৃষ্ণজয় গ্রামের কৃষক ছুট্টো মিয়ার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তার বাড়ির রাস্তায়, বসত ঘর, টিউবওয়েল, শৌচাগার, বাড়ির উঠোনসহ আঙ্গিনায় হাজার হাজার পোকা কিলবিল করছে। ছুট্টো মিয়া বলেন, আমরা ঝাড়– দিয়ে পরিষ্কার করেও পোকা কমাতে পারছি না। রাতে ঘুমালে গায়ে উঠে যায়। গায়ে লাগলে চুলকায়। বাড়ির চারদিকে কীটনাশক ছিটিয়েও কাজ হচ্ছে না, দিন দিন পোকা আরো বাড়ছে।
লেমুয়া ইউনিয়নের কসবা গ্রামের বাসিন্দা সিএনজি চালক বেলাল এবং আকবর হোসেন রূপক জানান, এই পোকা খেয়ে বাড়ির ৫টি মুরগী মারা গেছে। পুকুরের পানিতে এত বেশি পোকা কিলবিল করছে যে জেলেরা মাছ না ধরেই চলে গেছে।
অনুকূল আবহাওয়ায় বংশবিস্তারের শঙ্কা
ফসলবিনাশী ফল আর্মিওয়ার্ম পোকার আক্রমণে জেলায় ফসল উৎপাদনে ফের বিপর্যয়ের শঙ্কা রয়েছে। এ ব্যাপারে ফেনী সরকারি কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহকারি অধ্যাপক মোতাহার হোসাইন বলেন, সাম্প্রতিক বন্যা এ পোকার উপদ্রবের অন্যতম কারণ হতে পারে। পোকাটি সাধারণত মাঝারি ঠান্ডা ও গরমে বেশি বংশবিস্তার করে। বর্তমান সময়ের আবহাওয়া সবচেয়ে বেশি অনুকূলে রয়েছে। যা আমাদের জন্য বাড়তি শঙ্কার বিষয়।
তিনি বলেন, গ্রীষ্মকালে পোকাটি ৩০-৩৫ দিনে ও শীতকালে ৭০-৮০ দিনের জীবনচক্র সম্পন্ন করে। স্ত্রী জাতের পোকা সাধারণত পাতার নিচের দিকে ১৫০০-২০০০টি ডিম পাড়ে। ডিম ফুটে বের হয়ে পাতা বা ফল খাওয়া শুরু করে। পূর্ণাঙ্গ কিড়া মাটির ৮-১২ সেন্টিমিটার নিচে পুত্তুলিতে পরিণত হয়। উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়ায় পোকাটি ৪-৫টি জীবনচক্র সম্পন্ন করতে পারে। জীবনচক্রের বিভিন্ন ধাপে পূর্ণাঙ্গ পোকা অনেকদূর পর্যন্ত উড়ে যেতে পারে। এমনকি ঝোড়ো বাতাসের সঙ্গে কয়েকশ কিলোমিটার পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়তে পারে।
তিনি আরও বলেন, পোকাটির উপদ্রব নিয়ন্ত্রণের জন্য বাজারে রিপকর্ড নামে কার্যকরী একটি স্প্রেজাতীয় ওষুধ রয়েছে। কৃষকরা যদি যথাসময়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নেন, তাহলে ২০ শতাংশ ফসলের ক্ষতির আশংকা রয়েছে। এজন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সহযোগিতা নিয়ে দ্রুত কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
নিয়ন্ত্রণে কৃষিবিভাগের পদক্ষেপ
ফল আর্মিওয়ার্ম পোকার উপদ্রব নিয়ন্ত্রণে কৃষকদের পাশে দাঁড়িয়ে ইতোমধ্যে কার্যক্রম শুরু করেছে বলে জানিয়েছে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ফেনীর উপ-পরিচালক মো. একরাম উদ্দিন বলেন, পোকার উপদ্রব নিয়ন্ত্রণে জমিতে আলোর ফাঁদ ও পাখি বসার মত কিছু বসাতে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া বাজার থেকে বিভিন্ন বালাইনাশক প্রয়োগের বিষয়েও কৃষকদের বলা হচ্ছে। ফসল অনুযায়ী জমিতে সম্ভব হলে পানি রাখতেও পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। সবমিলিয়ে শঙ্কা থাকলেও এখনো নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
দেশকন্ঠ//