দেশকন্ঠ অনলাইন : দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল চিকিৎসা নামে ভোগান্তি বেড়েছে। সমস্যায় জর্জরিত এ হাসপাতালটি এখন নিজেই রুগ্ন হয়ে পড়েছে। পরীক্ষা-নীরিক্ষার অধিকাংশ যন্ত্রপাতিই অচল, ৪৮ শতাংশ চিকিৎসকের পদই শূন্য, শয্যার অপ্রতুলতাসহ নানান সমস্যা ও অনিয়মের মধ্যেই হাসপাতালটি রয়েছে। গত রোববার সারা দিন এ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা একাধিক রোগীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এসব দুর্ভোগের কথা। দূর -দূরান্ত থেকে এসে রোগীরা এ হাসপাতালে ভর্তি হয়ে পাচ্ছেন না কাঙ্খিত চিকিৎসা সেবা। অধিক অর্থ ব্যয় করে নির্ভর করতে হচ্ছে বেসরকারী ডায়াগনস্টিক সেন্টার গুলোর উপর।
দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে কর্মরত টেকনিশিয়ান পরিচয়দানকারী রেজাউল করিম ও রফিকুল ইসলাম বলেন, এ হাসপাতালে স্থাপন করা ৪৬ শতাংশ পরীক্ষা নিরীক্ষার যন্ত্রপাতিই অচল হয়ে রয়েছে। এ কারনে আমরা রোগীদের পরীক্ষা নিরীক্ষার কাজ সবগুলো করতে পারছিনা। তারা বলেন, শুধু এমআরআই যন্ত্রটিই নয় বর্তমানে হাসপাতালের ছোট-বড় সব মিলিয়ে ৪৬ শতাংশ যন্ত্রপাতিই অচল হয়ে রয়েছে।
দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা মোঃ আবুল কালাম জানান, চলতি বছরের শুরুতে গত জানুয়ারি মাসে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নিমিউ এন্ড টিসি বিভাগে হাসপাতালে অচল-সচল ও মেরামত যোগ্য যন্ত্রপাতির তথ্য প্রেরণ করা হয়েছে। সেখানে দেখা যায় ৫৫৬টি যন্ত্রপাতির বিপরীতে ২৫৭টি অচল। এর মধ্যে এমআরআই বা সিটি স্ক্যানের মত বড় যন্ত্র এবং পালস অক্সিমিটারের, মত ছোট যন্ত্র অচল হয়ে রয়েছে। তবে কিছু যন্ত্রপাতি মেরামত যোগ্য।
সম্প্রতি হাসপাতালে রেডিওলজি ও ইমেজিং বিভাগ ঘুরে দেখা যায়, পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে এমআরআই যন্ত্রটি। দীর্ঘদিন অচল থাকায় প্রিটার, কম্পিউটারসহ অন্যান্য ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ গুলো অচলাবস্থায় হাসপাতালে ষ্টোরে অযতেœ পড়ে রয়েছে। পাশের কক্ষে সিটি স্ক্যান যন্ত্রটি নষ্ট ছিলো প্রায় দুই বছর। সম্প্রতি মেরামত করা হলেও ফিল্ম না থাকায় সিটি স্ক্যান যন্ত্রটি বন্ধ রাখা হয়েছে। রোগীরা হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসে ঘুরে যাচ্ছেন, এ ধরনের ঘটনা প্রতিদিনই ঘটছে।
এমআরআই যন্ত্রটি পরিচালনা করতেন টেকনিশিয়ান গোপেশ চন্দ্র সরকার। তিনি জানান, ফিলিপস কোম্পানির এমআরআই যন্ত্রটি লেক্সিকন নামের একটি প্রতিষ্ঠান গত ২০১৩ সালে হাসপাতালে স্থাপন করে। প্রায় ৩ বছর ঠিকঠাক চললে পরবর্তীতে যন্ত্রটির হিলিয়াম লেভেল কমে যায়। কোম্পানী থেকে বেশ কয়েকবার টেকনিশিয়ান আসলেও ঠিক পড়তে পারেনি। এরপর থেকে যন্ত্রটি অযত্নে পড়ে রয়েছে। সরকারি হাসপাতালে এ যন্ত্রে শরীরের যেকোন একটি অঙ্গ ৩ হাজার টাকার মধ্যে এমআরআই সুবিধা পেতো রোগীরা।
হাসপাতালে সপ্তাহের ৬ দিন সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। অন্যান্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার সময় সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত করা হয়। হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, অধিকাংশ রোগীদের শয্যার পাশে রাখা বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্ট। কয়েকজন চিকিৎসক-নার্স জানান, বর্তমানে কিছু প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা-নীরিক্ষা, ইসিজি, আলট্রাসনোগ্রাম ছাড়া অন্য কোন পরীক্ষা-নিরীক্ষা এখানে হয়না। প্রায় ২৪ ঘন্টা হাসপাতালের করিডোর এবং ওয়ার্ডে বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের প্রতিনিধিরা থাকেন। কিছু ওয়ার্ড বয়ের সহযোগিতা নিয়ে রোগীদেরকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়ে যান এ প্রতিনিধিরা। বেসরকারি হাসপাতালে প্রতি পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সরকারি হাসপাতালের চেয়ে কমপক্ষে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ অতিরিক্ত টাকা দিতে হয় রোগীদের। রোগীদের পরীক্ষা নিরীক্ষার সঙ্গে কিছু চিকিৎসক জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। যারা সংশ্লিষ্ট ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পরামর্শ দেন রোগীদের।বিনিময়ে তারা পরীক্ষা-নিরীক্ষার একটি অংশ টাকা পেয়ে থাকে বলে অভিযোগ রয়েছে।
কয়েকদিন আগে মাথা ও ঘাড় ব্যাথা নিয়ে দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন জেলার পার্বতীপুর থেকে আসা জাহাঙ্গীর হোসেন(৬২)। চিকিৎসক তাঁকে এমআরআই করাতে বলেন। হাসপাতালের এমআরআই যন্ত্রটি অচল থাকায় স্থানীয় পুপলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে এমআরআই করান। এতে তাঁর খরচ পড়েছে সাড়ে ছয় হাজার টাকা। এ পরীক্ষাটির ক্ষেত্রে সরকারি হাসপাতালে নির্ধারিত ফি ৩ হাজার টাকা। জাহাঙ্গীর জানান, হাসপাতালের একজন ওয়ার্ড বয় সেই ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সঙ্গেযোগাযোগ করে দেন তাকে।
সম্প্রতি হাসপাতালে আইসিইউতে শয্যা না পাওয়ায় একটি বেসরকারি হাসপাতালে মস্তিষ্কের অস্ত্রপাচার হয় হবিবর রহমানের (৫২)। ওই হাসপাতালে চিকিৎসা ব্যয় হয়েছে ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা। হবিবর রহমানের বাড়ি দিনাজপুর ফুলবাড়ী উপজেলার আমবাড়ি গ্রামে।
হবিবরের পুত্র রিয়াজ হোসেন(২২) বলেন, রাতে বাবার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। রাত আড়াই টায় বাবাকে দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসি। ইন্টার্ণ চিকিৎসক সিটি স্ক্যান করার পরামর্শ দেন। কিন্তু হাসপাতালের মেশিন নষ্ট। বাইরে থেকে সিটি স্ক্যান করাতে হয়েছে। পরে আইসিইউতে বেড না পেয়ে বেসরকারি হাসপাতালে অপারেশন করায়। এরই মধ্যে জমানো টাকা শেষ হয়ে গেছে। দু'দিন পরে বেড ফাঁকা পেয়ে বাবাকে আবার সরকারি হাসপাতালে এনে ভর্তি করেছি। এখানে শুধুমাত্র গ্যাসের ওষুধ আর একটা এন্টিবায়োটিক ইনজেকশন পেয়েছি। বাকি সব ওষুধ বাইরে থেকে কিনতে হয়েছে। ট্রলি দিয়ে তৃতীয় তলায় বাবাকে নেওয়ার সময় প্রতিবার ১০০টাকা করে দিতে হয়েছে ওয়ার্ড বয়দের।
শয্যা সংকট ঃ
এ হাসপাতালে শয্যা সংখ্যা ৫০০টি রয়েছে।এর বিপরীতে প্রতিদিন গড়ে রোগী ভর্তি থাকেন ৯০০ থেকে ১ হাজার ১০০জন। বর্হি বিভাগে প্রতিদিন সেবা নেন বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত দেড় থেকে দু'হাজার শিশু-নারী-পুরুষ রোগী। বর্তমানে চিকিৎসক ও ওষুধ সংকট, নষ্ট যন্ত্রপাতি, দালালদের দৌরাতœ্য আউট সোর্সিং নিয়োগ ও দায়িত্ব পালনকারীদের বিষয়ে অনিয়মের অভিযোগ নিয়ে পুরো হাসপাতালটিই যেন রোগী হয়ে গেছে।
গত ১৯৯২ সালে তৎকালীন বিএনপি সরকার শাসন আমলে সে সময় প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বড় বোন খুরশিদ জাহান হকের প্রচেষ্টায় দিনাজপুর মেডিকেল কলেজের অগ্রযাত্রা শুরু করা হয়েছিল।
পরবর্তীতে ৫০০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল নির্মাণ হলে গত ২০০৬ সালে শুরু হয় স্বাস্থ্যসেবা। এর পর সময় পেরিয়েছে প্রায় দেড় যুগ। দীর্ঘ সময়ে হাসপাতালে স্বাস্থ্য সেবা উন্নতির বদলে ক্রমে অবনতি হয়েছে। রোগীদের অসন্তোষ ও ভোগান্তি বেড়েছে। হাসপাতালের সীমাবদ্ধতার এ সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে বেসরকারি হাসপাতাল গুলো। অন্যদিকে চিকিৎসার ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন রোগী ও তার স্বজনরা।
হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা চিকিৎসক ও অন্যান্য স্টাফরা বলছেন, নির্ধারিত বেডের চেয়েরোগী বেশী হওয়া, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দায়িত্ব-কর্তব্যে অবহেলা ও অদক্ষতা এবং অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পরায় চিকিৎসা সেবা ব্যাহত হচ্ছে।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকার শাসনের সময় গত ১৫ বছর এ হাসপাতাল পরিচালনা পরিষদের সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন সাবেক সংসদ সদস্য এবং সাবেক হুইপ ইকবালুর রহিম। হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা উন্নয়নে তিনি কারো মতামতের গুরুত্ব দিতেন না। নিজের অনুগতদের দিয়ে এক নায়ক তান্ত্রিক ভাবে হাসপাতাল পরিচালনা করেছেন। এ কারণে হাসপাতালের এমন দশা হয়েছে বলেও মন্তব্য করছেন জেলার সচেতের মহল।
হাসপাতালের পর্ন মাস্টার মাসুদ রানা জানায়, গত ৩ অক্টোবর হাসপাতালের সবকটি বিভাগে রোগী ভর্তি ছিলেন ৯৩৭ জন। বর্হিবিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন ১ হাজার ৩১৯জন। হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, ওইদিন শুধুমাত্র চতুর্থ তলায় মেডিসিন ওয়ার্ডে(পুরুষ ও নারী) ১৫৮ শয্যার বিপরীতে রোগী আছেন ২৯৫জন। ওয়ার্ডের মেঝেতে কোন জায়গা ফাঁকা নেই। করি ডোরের দু'পাশে পাতানো বেডে রোগী রয়েছে। মাঝে একজন মানুষ চলাচল করা যায় এতটুকু জায়গা ফাঁকা। একই অবস্থা সার্জারি, গাইনী ও লেবার ওয়ার্ডে।
শিশু বিভাগে বাচ্চাকে কোলে নিয়ে এক মা বলেন, দু'দিন আগে ভর্তি হয়েছি। একেতো ঠান্ডা লাগার কারনে বাচ্চার শ্বাসকষ্ট, তার উপর বেড না পাওয়ায় মেঝেতে থাকার কারনে বাচ্চার আরও ঠান্ডা লেগে যাওয়ার ভয়ে, রাতে বাচ্চা কোলে নিয়ে বসে থেকেছেন।
শিশু ওয়ার্ডের চিকিৎসক ডাঃ বদরুল আলম বলেন, ‘এ ওয়ার্ডে নির্ধারিত বেড সংখ্যা ৩৯টি। কোন দিন ১৪০ জন পর্যন্ত রোগী থাকে। এছাড়াও রোগীর সঙ্গে মাসহ অন্তত দু'জন স্বজন থাকেন। তিনি বলেন, শিশু ওয়ার্ডে ৫ জন চিকিৎসক রয়েছে। যেখানে কমপক্ষে ১৫ জন চিকিৎসকের প্রয়োজন। শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে। তাই স্পর্শকাতর এওয়ার্ডটির জন্য পর্যাপ্ত জায়গাও প্রয়োজন।’
দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডাক্তার এটিএম নুরুজ্জামান জানান, এখানে ৪৮ শতাংশ চিকিৎসকের পদ শূন্য রয়েছে।
হাসপাতালের অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী এখানে চিকিৎসকদের অনুমোদিত পদ ২১২টি। সেখানে কর্মরত আছেন ১১১জন। হিসেব অনুযায়ী ৪৭ দশমিক ৬৪ শতাংশ চিকিৎসকের পদ শূন্য রয়েছে। এর মধ্যে সিনিয়র কনসালটেন্ট ১২জনের স্থলে ৫ জন, জুনিয়র কনসালটেন্ট ৮ জনের স্থলে ৩ জন, আবাসিক সার্জন ১৩ জনের স্থলে ৯ জন, বিভিন্ন বিষয়ে রেজিস্ট্রার ও সহকারী রেজিস্ট্রার, চিকিৎসকসহ ৭০ জনের স্থলে ৩১জন এবং অ্যানেসথেসিওলজিস্ট ১৫ টি পদের বিপরীতে রয়েছেন মাত্র ১জন। তবে মেডিকেল অফিসার ৫০পদের বিপরীতে ৪৩জন কর্মরত আছেন। এছাড়াও দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ শ্রেণীর ১৩৩ পদের বিপরীতে ৬৫ টি পদ শূন্য রয়েছে।
হাসপাতালের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিভাগ নিউরো সার্জারি। এর চিকিৎসা ব্যয় বহুল হলেও উত্তরাঞ্চলের মানুষদের ভরসার স্থল হয়েছিল এ হাসপাতাল। নিউরো সার্জারি রোগীদের পৃথক ওয়ার্ড না থাকায় হাসপাতালের তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় সাধারণ সার্জারি ওয়ার্ডেই রাখা হয়েছে রোগীদের। প্রতিদিন গড়ে নিউরো সার্জারী রোগী ভর্তি থাকেন ২০ থেকে ২৫জন।
গত ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে হাসপাতালে চালু হয় নিউরো সার্জারি অস্ত্রপাচার। গত শনিবার পর্যন্ত হাসপাতালে প্রায় ৮০০ নিউরো সার্জারী রোগীর অস্ত্র পাচার হয়েছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১জন চিকিৎসক দিয়েই চলছে নিউরো সার্জারি বিভাগ। একমাত্র নিউরো সার্জারি বিশেষজ্ঞ সারোয়ার মোর্শেদ আলম বলেন, সপ্তাহে দু'দিন অস্ত্রপাচার করা হয়। শুরু থেকে একজন চিকিৎসক দিয়েই চলছে বিভাগটি। এক্ষেত্রে সার্জারি ওয়ার্ডের চিকিৎসক ও ইন্টার্ণি চিকিৎসকদের সহায়তা নিয়ে তিনি কাজ চালাছেন বলে দাবি করেন। এরইমধ্যে কোমড়ের হাড়ের অস্ত্রোপাচারের গুরুত্বপূর্ণ সি-আর্ম মেশিনটি সহ কয়েকটি মেশিন বিকল হয়ে রয়েছে। ফলে কিছু রোগীকে ফেরত পাঠাতে হচ্ছে।ঠিকাদারের মাধ্যমে স্বাস্থ্য বিভাগের বেঁধে দেওয়া ২৩৬ জনের দিনে হাজারে বেতন দেয়া হয়।ঠিকাদারী নিয়োজিত ৩৮৮ জন আউটসোর্সিং কর্মচারীদের মধ্যে ওই বেতনের টাকা ভাগ করে দেয়া হয়।
সম্প্রতি মাথায় আঘাত জনিত সমস্যায় মামাকে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এমদাদুল হক। পরের দিন বিকেলে চিকিৎসক কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা দিয়েছেন। সার্জারি ওয়ার্ডের করিডোরে কথা হয় এমদাদুলের সঙ্গে মামাকে হাসপাতালের বাইরে নিতে ট্রলি ও ওয়ার্ডবয় খুঁজছেন তিনি। মূহুর্তেই একজন হাজির হলেন, কথা বললেন তার সঙ্গে পরে জানা যায় ১০০টাকার বিনিময়ে ট্রলিতে নিচতলায় নামিয়ে দিয়েছেন ওই ব্যক্তি।
জরুরী বিভাগ থেকে ওয়ার্ডে নেওয়া, ওয়ার্ড থেকে হাসপাতালের বাইরে আনাসহ ছোট খাটো প্রায় সব কাজেই আউটসোর্সিং কর্মচারীদেরকে টাকা দিলে সেবা মেলে রোগীদের। হাসপাতালে আসা রোগীদের বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিকে পাঠিয়ে সেখান থেকে কমিশন গ্রহণ করার অভিযোগও রয়েছে। হাসপাতালের ওষুধ-স্যালাইন এমনকি ফ্যান পর্যন্ত চুরির ঘটনা আছে।
গত মে মাসে হাসপাতালে পুলিশ অভিযান চালিয়ে ২২ জন দালালকে আটক করে জেল হাজতে প্রেরণ করেছেন।
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে আউটসোর্সিং কর্মচারী রয়েছেন ৩৮৮জন। যদিও মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন আছে ৫ ক্যাটাগরিতে ২৩৬জনের। তাদের বেতন ধরা হয়েছে সাড়ে ১৬ হাজার থেকে ১৮ হাজার টাকা। গালফ সিকিউরিটি সার্ভিসেস প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানী মাসিক দেড় লাখ টাকা কমিশনে এ জনবল সরবরাহ করেছেন। গত ২০১৯ সালে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আউটসোর্সিংয়ে ১৫২জনকে অতিরিক্ত নিয়োগ দেয়। ২৩৬ জনের বেতন ৩৮৮জনের মধ্যেভাগ করে দেওয়া হচ্ছে।
গত এক সপ্তাহ আউটসোসিংয়ে কর্মরতদের খোঁজ নিয়ে দেখা যায় কাগজে কলমে ৩৮৮জনের নাম পেলেও খোঁজ মেলেনি ২৫জনের। নিচ তলায় আউটসোর্সিং অফিসে হাজিরা খাতায়ও স্বাক্ষর পাওয়া যায়নি অনেকের।
আউটসোর্সিং কর্মরতদের দেখভাল ও বেতনাদি পরিশোধসহ যাবতীয় কাজ করেন হাসপাতালের ওয়ার্ড মাস্টার মাসুদ রানা ও ফারুকুল আলম মামুন। অতিরিক্ত ১৫২ জনের তালিকা তাদের কাছে দেখতে চাইলে নানা টালবাহানা করে শেষ পর্যন্ত দেখাতে পারেনি।
জানা গেছে,এক আউটসোর্সিং কর্মচারী বলেন, এমনও অনেকে আছেন মাসের একদিনও আসেনা। মাস শেষে শুধু বেতন তোলে। আউটসোর্সিংয়ে কাজ করাদের অনেকেই হাসপাতালে বড়পদে চাকুরী করে তাদেরই স্বজন। হাসপাতালের টয়লেট থেকে শুরু করে করিডোর আশপাশ নোংরা থাকে। যদি এত গুলো লোক সঠিক দায়িত্ব পালন করতো তাহলে মানুষ আরও ভালো সেবা পেতো।
অপর একজন আউটসোর্সিং কর্মরত শফিকুল বলেন, প্রতিমাসে ব্যাংক থেকে মেসেজ পাই ১৬ হাজার ১৭৭টাকার। ওয়ার্ড মাস্টার বেতন দেন ৯ হাজার ২০০টাকা। ২৩৬ জনের ব্যাংকের চেক বই গুলো স্বাক্ষর করে নিয়ে রেখেছেন হাসপাতালে। বর্তমান যুগে ৯ হাজার ২০০টাকায় সংসার চলেনা। বাধ্য হয়েই হাসপাতালে অনৈতিক ভাবে আয়ের সাথে জড়িয়ে পড়ছেন আউটসোর্সিং কর্মচারীরা।
এসব বিষয়ে দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডাঃ এটিএম নুরুজ্জামান বলেন, ‘সারাদেশে প্রান্তিক হাসপাতাল গুলোতে চিকিৎসক সংকট রয়েছে। বিষয়টি মন্ত্রণালয়কে অবগত করানো হয়েছে। হাসপাতালের এমআরআই যন্ত্রটি পুরোপুরি অচল। সম্প্রতি সিটি স্ক্যান যন্ত্রটি মেরামত করা হয়েছে। অচল যন্ত্রপাতির তালিকা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। তিনি বলেন, এখানে নির্ধারিত বেডের চেয়ে দ্বিগুন রোগী থাকে। হাসপাতালের চতুর্থ তলা সম্প্রসারণের কাজ চলছে। মেয়াদ শেষ হলেও গণপূর্ত বিভাগ হস্তান্তর করতে পারেনি। সেটি চালু হলে শয্যা সংকটটা কেটে যাবে। আউটসোর্সিং কর্মচারীদের বিষয়ে তিনি বলেন, তাদের বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগ পেয়েছি। তদন্ত পূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
দেশকন্ঠ//