দেশকন্ঠ অনলাইন : জেলা শহরে রাস্তার মোড় গুলোতে জমে উঠেছে শীতের আগমনে বাঙ্গালীর গ্রামীণ ঐতিহ্য পিঠার ব্যবসা। পিঠে খেতে দল বেঁধে ভিড় করছে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ।
দিনাজপুর শহরের জনবহুল স্থান রাস্তার মোড়, বাস স্ট্যান্ড, রেলওয়ে স্টেশনসহ ব্যস্ততম এলাকা গুলোতে পিঠা ব্যবসায়ীরা হরেক রকমের পিঠার দোকানে পসরা নিয়ে বসেছেন। এ পিঠার ব্যবসা শীত মৌসুমে জমে উঠে। তবে পিঠার ব্যবসা বছরে হেমন্তর আগমনে শুরু হয়ে বসন্তের শেষ দিক পযন্ত প্রায় ৬ মাস চলে। পিঠা বানানে শুরু হয় কার্তিক মাসের বিকেল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত পিঠা কেনা-বেচা করেন দোনানীরা।
বর্তমান অবস্থায় মানুষের জীবন যাত্রার মান আধুনিক হওয়ার কারণে এখন আর গ্রামের বাড়িতে পিঠার উৎসব শীতকালে খুব কম দেখা যায়। গ্রামের হাট বাজার ও শহরে এর প্রভাব বেশি পড়েছে। কারণ শহরের মানুষ তুলনা মূলক ভাবে ব্যস্ততার কারণে পিঠা বানানোর সময় পান না। ফলে তারা শহরে গড়ে উঠা পছন্দের এসব ভাসমান পিঠার দোকান থেকে খুব সহজেই শীতের পিঠার স্বাদ নিতে পারছেন।
দিনাজপুর শহরের নিমতলা মোড়, কালিতলা থানার মোড়, সুইহারি বাসস্ট্যান্ড, নিমনগর ফুলবাড়ী বাসস্ট্যান্ড, রেলওয়েস্টেশনের সম্মুখে,পাহাড়পুর ইকবালস্কুলের মোড়, জেলাস্কুলের সম্মুখে, কালিতলা প্রেসক্লাবের সম্মুখে,মহারাজা মোড়,উপশহর বাজার,হাউজিং মোড়, ফুলহাট মোড়, হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মুখে, সরকারি কলেজ মোড়, বালু বাড়ী মহিলা কলেজ মোড়,রামনগর ছয় রাস্তারমোড়,কাঞ্চন ব্রিজ মোড়, চাউলিয়া পট্টি মোড়,ষষ্ঠীতলা মোড়সহ প্রায় শতাধিক স্থানে এ ধরনের ভ্যারাইটিজ শীতকালীন পিঠার দোকানে উৎসব সহকারে বিকেল থেকে রাত ১২ টা পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের পিঠার বেচাকেনা চলে।
শহরের ফুলবাড়ী বাস স্ট্যান্ডে পিঠার ব্যবসায়ী সৈয়দ আলী(৫৫)র সঙ্গেকথা বলে যানা যায়, শীতকালীন সময়ে কার্তিক মাস থেকে তার দোকানে হরেক রকমের পিঠার আয়োজন হয়। তিনি নিজে তার দু'পুত্র আরো দু'জন কর্মচারী কে নিয়ে ৫ জন মিলে এ পিঠার দোকান সামলাতে হয়। তার দোকানে আধুনিক একটি খড়ি চুলায় ৭টি মুখ রয়েছে। একসাথে একটি চুলার ৭টি আগুনের মুখ রয়েছে। ওই ৭টি আগুনের মুখে এক সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের পিঠা বানানোর কাজ চলে। হেমন্তর শুরুতে শীতের আগমনে তার দোকানের গ্রাহকদের চাহিদা অনুযায়ী, চিতাই পিঠা,ডিম পিঠা,ভাপা পিঠ, খেজুর গুড় দিয়ে সুগন্ধি চালের আটা মিশিয়ে সুসাদু নারকেলপিঠা,তালপিঠা,পাটিসাপটা,ঝালপিঠা,তেলপিঠা,পাওয়া যায়।
এসব পিঠের স্বাদ নিতে বিকেল থেকেই বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের, ছেলে-মেয়ে শিক্ষার্থীরা দল বেঁধে পিটার স্বাদ নিতে ভিড় জমায়। এসব হরেক রকম পিঠে খেয়ে শিক্ষার্থীরা নিজেদের শীতের পিঠা উৎসবের চাহিদা পূরণ করে থাকেন।
পিঠে খেতে আসা, দিনাজপুর সরকারি মহিলা কলেজের শিক্ষার্থী,মিনারা আক্তার বলেন, তার বাড়ি পঞ্চগড় জেলায়, এখানে লেখাপড়া করছেন, তারা ৪ বান্ধবী মিলে, প্রায় দিন পিঠার দোকানে এসব পিঠা খেয়ে থাকেন। পিঠা খাওয়ার পর রাতের খাবার না খেলেও চলে। একই কথা বলছেন, দিনাজপুর পলিটেকনিক্যাল ইন্সটিটিউট শিক্ষার্থী নাঈমুল হাসান ও রবিউল ইসলাম। তারা কয়েক বন্ধু মিলে শীতের সময় এভাবে উৎসব করে বিভিন্ন ধরনের পিঠা খেয়ে থাকেন।
পিঠা দোকানী সৈয়দ আলী (৫৫) বলেন,তার দুই পুত্র সৌরভ ও গৌরবসহ আরো দুই কর্মচারী নিয়ে তাদের শীতকালীন পিঠের দোকান চলছে। প্রতিদিন ৪০ থেকে ৫০ কেজি আতপ চালের সুগন্ধি চাল বাড়িতে ভিজিয়ে মেশিনে ভাঙ্গিয়ে চালের গুড়া তৈরি করেন। এ সুগন্ধি আতপ চালের আটা দিয়ে সব ধরনের পিঠাই বানানো সম্ভব হচ্ছে। শীত মৌসুমে ভাপা পিঠা বেশি চলে। ভাপা পিঠাই নারকেল ও খেজুরের গুড় দিয়ে বানানো হয়। প্রতিটি পিঠা দশ টাকা করে বিক্রি করা হয়। এর সঙ্গে রয়েছে চিতই পিঠা, এ পিঠা ঝাল ও ধনিয়া পাতার ভর্তা এবং গুড় দিয়ে গ্রাহকরা খেয়ে থাকেন। এছাড়া চিতই পিঠায় ডিম দিয়ে তৈরি করা হয়। শুধুএ পিঠা ১০ টাকা, কিন্তু ডিম দিয়ে বানানো পিঠা ২৫ টাকা বিক্রি করা হয়। ঝালপিঠ,তেলপিঠা,নারকেলপিঠা ১০ টাকায় বিক্রি করা হয়।
পিঠে দোকানী বলেন, স্বাস্থ্য সম্মত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ভাবে গ্রাহকদের চাহিদার মত পিঠে বানিয়ে তাদের সরবরাহ করা হয়। ফলে গ্রাহকরা নিজ চোখে পিঠে বানানো দেখে আগ্রহ সহকারে পিঠা খেয়ে তৃপ্তি পাচ্ছন।অনেকে আবার বাড়ির জন্য দোকান থেকে পিঠে নিয়ে যাচ্ছেন।
ভ্রাম্যমাণ এসব দোকানগুলোর প্রতিটিতেই সুস্বাদু পিঠার স্বাদ নিতে ভিড় করছেন ক্রেতারা। ফলে দোকানীদের কেউ দিনে ৮ হাজার আবার কেউ ১০ হাজার টাকার পিঠা বিক্রি করতে পারছেন।
রসুন-মরিচবাটা, ধনিয়াপাতা বাটা, শুঁটকি, কালোজিরা, সর্ষে ভর্তাসহ নানা রকম উপকরণ মিলিয়ে বিক্রি করা হয় চিতই পিঠা। সন্ধ্যায় হিমেল হাওয়ায় খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে পিঠা খেতে অনেকেই ভিড় জমাচ্ছেন ভ্রাম্যমাণ এসব পিঠার দোকান গুলোতে।
দোকানীরা বলছেন, চিতাই, কুলি, ভাপা, ডিমচিতই, তেলের পিঠা ও পাটিসাপটা, ডিম-ঝাল পিঠাসহ বিভিন্ন ধরনের পিঠা বিক্রি করেন তারা। এর মধ্যে ভাপাপিঠা, চিতাই আর ডিম-ঝাল পিঠার কদর বেশি।
শহরের নিমতলা মোড়ে পিঠার দোকান নিয়ে বসেছেন ৪ মহিলা। রেজিয়া বেগম,আসমানি খাতুন, জহুরা বেগম ও আরতি রানী। গত দুই যুগ ধরে প্রতি বছর কার্তিক মাসের শুরু থেকে পিঠা বিক্রি শুরু করেন তারা। তাদের সঙ্গে তার স্বামী ও ছেলে-মেয়ে সন্তানেরা পিঠা দোকানে বেচা বিক্রিতে সহযোগিতা করেন।
তাদের ব্যবসা কার্তিক থেকে চলে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত। শুরুর দিকে শহরে নিমতলায় একটি পিঠার দোকন ছিল। গ্রাহকের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায়, এখন ওই একই স্থানে ৪টি পিঠার দোকান বসেছে। এ ৪টি পিঠার দোকানে প্রতিদিন প্রচুর গ্রাহকের আগমন হয়। গ্রাহকেরা লাইন ধরে নিজের ইচ্ছামত পছন্দের পিঠা অর্ডার দিয়ে অপেক্ষা করেন। গরম গরম বানানো পিঠা তারা ওখানে দাঁড়িয়ে পিঠা খেয়ে স্বাদ নেন। আমার অনেকেই অর্ডার দিয়ে বাড়ির জন্য পিঠার পার্সেল নিয়ে যান। পিঠা দোকান গুলোতে স্বামী স্ত্রী দু'জনে একটি মাত্র চুলো নিয়ে পিঠা বিক্রি শুরু করলেও, এখন তাদের অন্তত ৫/৬টি চুলায় পিঠা তৈরি করছেন।স্বামী স্ত্রী ছাড়াও কয়েকজন কর্মচারী রয়েছে পিঠার এসব দোকানে। এদের কেউ পিঠা বানানো, আবার কেউ ক্রেতাদের পিঠা পরিবেশনের কাজে ব্যস্ত থাকেন। এখানে দেখলে মনে হয় প্রতিদিন চলছে শীতের মহা পিঠা উৎসব।
পিঠা দোকানীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের প্রতিদিন এখন ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা পিঠা বিক্রি হচ্ছে। খরচ বাদে তাদের ২০০০ থেকে আড়াই হাজার টাকা মুনাফা টিকছে।এভাবে তারা ভালোভাবে খেয়ে পড়ে বেঁচে আছেন। অনেকে ঘর-বাড়ি ঠিকঠাক করেছেন। অনেকের ছেলে-মেয়েরা লেখাপড়ায় উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছেন।তাদের সংসারে এ পিঠা দোকান থেকে ব্যয়ভার নির্ভর হচ্ছে। তারপর গরমের মৌসুমে কেউ কেউ অন্য কাজে জড়িয়ে পড়েন। কেউ চলে যান গ্রামে পরিবারের কাছে।
দেশকন্ঠ//