দেশকন্ঠ অনলাইন : ২০২৪ সাল শুরু হইয়াছিল যুদ্ধের মধ্য দিয়া। বিশেষজ্ঞরা বারবার সতর্ক করিয়া বলিয়াছিলেন যে, ভালো যাইবে না সামনের দিনগুলি। যেই বৎসরের শুরু ও শেষ হয় যুদ্ধের মধ্য দিয়া, সংগত কারণেই সেই বৎসর লইয়া অধিক প্রত্যাশা থাকে না। বর্তমানে আমরা ইহাই প্রত্যক্ষ করিতেছি। ইউরোপের মাটিতে যুদ্ধ চলিতেছে, সংঘাতের দামামায় কাঁপিতেছে পুণ্যভূমি মধ্যপ্রাচ্য। ২০২২ সালে বিশ্ব জুড়িয়া মহাসংকট বহিয়া আনা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এখনো চলিতেছে। ইউক্রেন যুদ্ধে এখন পর্যন্ত উভয় পক্ষের বহু হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতির ফলে মানবিক সংকট সৃষ্টি হইয়াছে। বিশ্বমানবতার এই সংকটকে আরো ভয়াবহ করিয়া তুলিয়াছে চলমান গাজা যুদ্ধ। হামাস ও ইসরাইলের মধ্যে চলমান এই যুদ্ধে এখন পর্যন্ত ৪০ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হইয়াছে, আহত লক্ষাধিক। দুঃখজনকভাবে নিহত ও আহতদের অধিকাংশই শিশু ও নারী। ইহা বিশ্বের ইতিহাসে যেন এক 'মহা ট্র্যাজেডি'।
বৈশ্বিক অস্থিরতার অভিঘাতে স্বভাবতই ক্ষতবিক্ষত হইতেছে বিশ্ব অর্থনীতি। চলতি বৎসরের শুরুর দিকে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম প্রকাশিত 'চিফ ইকোনমিস্ট আউটলুক'-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৪ সালে বিশ্ব অর্থনীতি আরো দুর্বল হইয়া পড়িবে এবং তা বিশ্বের অর্থনৈতিক বিভাজনকে প্রকটতর করিয়া তুলিবে। ইহাই যেন বর্তমান বিশ্বের চিত্র। বিশ্ব অর্থনীতিতে এখন চরম 'আকাল' চলিতেছে, সৃষ্টি হইয়াছে চরম অনিশ্চিয়তা। ইহার সহিত কঠোর আর্থিক অবস্থা, ভূরাজনৈতিক ফাটল এবং জেনারেটিভ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দ্রুত বিকাশের ন্যায় নানাবিধ চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন বিশ্ব অর্থনীতি। ইহার ফলে উন্নত বিশ্বের অবস্থাই যেইখানে সঙ্গিন হইয়া উঠিতেছে, সেইখানে উন্নয়নশীল ও দরিদ্র দেশগুলি কী অবর্ণনীয় দুর্দশা-দুর্ভোগে পড়িয়াছে, তাহা সহজেই অনুমেয়।
বিশ্বের নানা প্রান্তে যুদ্ধ ও যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করিলেও রাশিয়া-ইউক্রেন ও ইসরাইল-ফিলিস্তিন যুদ্ধই বিশ্ব পরাশক্তিগুলির ক্ষমতা ও আধিপত্যের প্রধান সমীকরণ হইয়া উঠিয়াছে। বিশ্লেষকদের দাবি, ভবিষ্যতে বৈশ্বিক গণতন্ত্র ব্যাপক চাপের মধ্যে থাকিবে, কর্তৃত্ববাদী ঝোঁক-প্রবণতা বৃদ্ধি পাইবে। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও অর্থনৈতিক ধারা-প্রকৃতিতে সেই পরিবর্তনের ইঙ্গিতও পাওয়া যাইতেছে। এই অবস্থায় সামনের দিনগুলিতে আর কী কী দেখিতে হইতে পারে, তাহা যেন সকলকে তাড়াইয়া ফিরিতেছে! মূলত দুই দুইটি বৃহৎ সংঘাতকে সঙ্গে লইয়া বিশ্ব নূতন বৎসরে যাত্রা শুরু করিলেও আশা ছিল, নূতন করিয়া ঘুরিয়া দাঁড়ানো যাইবে; কিন্তু সেই আশা ক্রমশ ধোঁয়াশা হইয়া উঠিতেছে। কোনো কার্যকর আলাপ-আলোচনা নহে, শান্তি-প্রক্রিয়া নহে, কেবল তীব্র অস্ত্র প্রতিযোগিতাই বর্তমানে অধিক দৃশ্যমান। বেসামরিক মানুষ এইখানে বড্ড অসহায়! উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আর শঙ্কাই তাহাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। প্রতিদিন মৃত্যুর পাহাড় গড়িয়া উঠিতেছে। অথচ সমগ্র বিশ্বের অধিকাংশ মানুষই সর্বদা শান্তিকামী; কিন্তু অস্ত্রের খেলা আর দখলদারিত্বের মুখে এই সকল শান্তিপ্রিয় মানুষ পদতলে পিষ্ট হইতেছে, যাহা এক কঠিন পরিতাপের বিষয়।
মধ্যযুগের কবি জ্ঞানদাস বড্ড আক্ষেপ করিয়া বলিয়াছিলেন, 'সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু/ অনলে পুড়িয়া গেল।' আজিকার দিনে আমরা কবির ভাষায় বলিতে পারি, 'ইটের পরে ইট, মাঝে মানুষ কীট'। আমরা সুউচ্চ অট্টালিকা গড়িয়া তুলিয়াছি; কিন্তু সেইখানে কি সুখের ঘুম ঘুমাইতে পারিতেছি? আমরা সভ্য হইয়াছি দুর্বার গতিতে, উন্নতি-সমৃদ্ধির পাল্লাও হালকা নহে, তথাপি প্রকৃত সুখ কি ভোগ করিতে পারিতেছি? বস্তুত, ইহার জন্য দায়ী দেশে দেশে চলমান হানাহানি, সংঘাত-সংঘর্ষ ও যুদ্ধবিগ্রহ। মনে রাখিতে হইবে, আমরা এমন এক যুগে বাস করিতেছি, যেইখানে সকল ক্ষেত্রে সমাধানের মোক্ষম তথা কার্যকর উপায় হইল 'কূটনীতি'। সীমান্তে গোলাগুলি বা বেসামরিক মানুষের ঘরবাড়িতে বোমা নিক্ষেপ করিয়া নহে, সমস্যার সমাধানে পক্ষগুলিকে বসিতে হইবে আলোচনার টেবিলে। জুতসই আলাপ-আলোচনা ও সমঝোতার মাধ্যমে সকল ধরনের সংঘাত, হানাহানির রাস্তা হইতে পক্ষগুলি দ্রুত ফিরিয়া আসিবে বলিয়া সকলের প্রত্যাশা।
দেশকন্ঠ//